বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা সংবাদপত্র “দ্য মুসলমান” সম্পর্কে জানেন কী?

ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তূপাকৃতি কাগজ, কলম, কালির বোতল। তার মধ্যে বসে ঘাড় গুঁজে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লিখে যাচ্ছেন একজন। ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকার অফিসে ঢুকলে দেখা যাবে এমন ছবি। কম্পিউটারের ব্যবহার বর্জিত, সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা এই পত্রিকার বয়স এখন ৯১ বছর।
অফিস চেন্নাইয়ে। সম্পাদকের নাম সাইয়েদ আরিফুল্লাহ। প্রায় ১০ বছর তিনি এই পত্রিকাটির হাল ধরে রেখেছেন।

‘দ্য মুসলমান’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯২৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা আরিফুল্লার দাদা সাইয়েদ আজাতুল্লাহ। তাঁর মনে হয়েছিল, মুসলমানদের কথা তুলে ধরার জন্য একটি সংবাদপত্রের প্রয়োজন। সেই ভাবনা থেকেই ভূমিষ্ঠ হয় ‘দ্য মুসলমান’।
শুরুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত পত্রিকাটির দায়িত্ব সামলেছেন তিনজন সম্পাদক। সাইয়েদ আজাতুল্লাহ, তার পুত্র সাইয়েদ ফাজলুল্লাহ এবং বর্তমানে সাইয়েদ আরিফুল্লাহ। চার পৃষ্ঠার এই পত্রিকাটির প্রায় সব খবর ও লেখা আরিফুল্লাহ নিজে বাছাই করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের করেসপণ্ডেন্ট। তবে ‘দি ইকনোমিস্ট’-এর মত তারাও পত্রিকায় কোনও প্রতিবেদকের নাম উল্লেখ করেন না।

প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে দুইজন অনুবাদক অফিসে আসেন। তাঁরা যে কোনও সংবাদ উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন। দুই ঘন্টা পরে আসেন তিনজন ক্যালিওগ্রাফার। এদেরকে ‘কাতিব’ বলা হয়। তারা ক্যালিগ্রাফিক কলমের মাধ্যমে প্রত্যেকটি সংবাদ পত্রিকার কাগজে লিপিবদ্ধ করেন। তবে এখন উর্দু ক্যালিওগ্রাফি শিল্পীর সংখ্যা লুপ্তপ্রায়। সম্পাদক আরিফুল্লাও জানালেন, লেখার জন্য অভিজ্ঞ লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

লেখার কাজ শেষ হলে লাগানো হয় বিজ্ঞাপন। এরপর প্রিন্টের জন্য নেগেটিভে লাগানো হয় পত্রিকাটি। দুপর থেকে শুরু হয় পত্রিকার প্রিন্ট। সন্ধ্যা নাগাদ প্রায় ২১,০০০ পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় ‘দ্য মুসলমান’। দাম, ৭৫ পয়সা।

এই সংবাদপত্রে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়-সহ প্রায় সমস্ত রকমের খবর প্রকাশ পায়। মিশরের নির্বাচন থেকে শুরু করে ‘কারসিনোজেনিক’ কফি – সবকিছু। তবে অধিকাংশ উর্দু সংবাদপত্রের মত ‘দ্য মুসলমান’ও সংবাদের চেয়ে ‘মতামত’ প্রকাশকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।


অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও উর্দু পত্রিকাটির ভক্ত শামসুর রেহমান আলাভির কথায়, ‘আমাদের দেশের উর্দু সংবাদপত্রের আয় খুব কম। তাই তারা ব্রেকিং নিউজ করতে পারে না। ফলে মতামত ও প্রাসঙ্গিক সংবাদ প্রকাশে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।’ তবে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পায় ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষা।

সারা দেশজুড়ে রয়েছেন এই সংবাদপত্রের গ্রাহকেরা। দিল্লি, কলকাতার অনেক পরিবার বংশপরম্পরায় এই পত্রিকার গ্রাহক। তাদেরকে কুরিয়ারের মাধ্যমে পত্রিকা পাঠানো হয়। প্রকাশ পায় বেশ কিছু বিজ্ঞাপনও। ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় জুয়েলারি, ফার্নিচার, ভ্রমণ সংস্থা, এমনকি কিছু সরকারি টেন্ডারেরও বিজ্ঞাপনও থাকে।

আরও পড়ুন : পেশায় হকার দীনেশ ১৭বছর ধরে হাতে লিখে খবরের কাগজ বিক্রি করেন

আরও পড়ুন : হাতের লেখা না কম্পিউটারের কোন ফন্ট? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হস্তাক্ষর এই কিশোরীর

পত্রিকাটির প্রথম পাতায় প্রকাশ পায় প্রধান শিরোনাম ও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংবাদ। দ্বিতীয় পাতায় সম্পাদকীয়। বাকি দুই পৃষ্ঠায় স্থানীয় সংবাদ ও বিজ্ঞাপন। সোমবারের সংখ্যা একটু অন্যরকম। এদিন কোরান ও ইসলামী ইতিহাস নিয়ে নিবন্ধ থাকে বেশী।

গত ৯১ বছরের প্রত্যেক দিন প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য মুসলমান’। এমনকি দেশভাগের সময়েও চালু ছিল। সুতরাং এর পরে কী ঘটবে? সেটা ভবিষ্যতের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছেন সম্পাদক আরিফুল্লা।