সাধারণত বড় রকমের কোন রোগ বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা ছুটে যাই সরকারি হাসপাতালে বা বেসরকারি নার্সিংহোমে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমরা সবরকম চেষ্টা করি নিজের নিজের আর্থিক ক্ষমতা অনুযায়ী। আজ আমাদের দেশে যদিও প্রয়োজনের তুলনায় হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের সংখ্যা অনেক কম, তবুও জীবনদায়ী পরিষেবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবার একটাই চিন্তা থাকে কীভাবে নার্সিংহোমে গিয়ে সঠিক পরিষেবা পাওয়া যাবে।
কারন হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে রোগীকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে বেশিরভাগ সময় দেখা যাচ্ছে রোগী এবং তার পরিবার নার্সিংহোমের প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এমনকি ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েও অনেকসময় রোগী তাদের প্রাণও হারাচ্ছে বা হারাচ্ছে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই রোগীদের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য ভারতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক অতি সম্প্রতি একটি সনদ প্রকাশ করেছেন যা “রোগীদের অধিকারের সনদ” বলে পরিচিত।

তথ্যের অধিকার
আপনি যেখানে রোগী হিসাবে ভর্তি হয়েছেন বা যে ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন আছেন সেখানে আপনাকে অবশ্যই জানাতে হবে আপনার রোগের সম্পর্কে। অর্থাৎ হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি থাকাকালীন আপনার রোগের সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে চাইলে ডাক্তার বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ আপনাকে তা জানাতে বাধ্য থাকবে।এছাড়াও রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি, চিকিৎসার পদ্ধতি, ইত্যাদি সম্বন্ধে রোগী বা রোগীর আত্মীয় জানতে চাইলে তাকে জানাতে বাধ্য থাকবে ডাক্তার বা হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কতৃপক্ষ। আর এটা জানানোর সময় রোগী যেভাবে সহজেই বুঝবে সেরকম সহজ সরল ভাষায় জানাতে হবে। এছাড়াও যে ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করছেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা চিকিৎসাগত যোগ্যতা জানার অধিকারও আপনার কাছে আছে।

রোগী সম্বন্ধীয় রেকর্ড এবং রিপোর্টের অধিকার
রোগী এবং তাদের নিকটাত্মীয় যারা রোগীর যত্নে বর্তমান তারা হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষের কাছে রোগী ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘন্টার পর বা রোগী মুক্তি পাওয়ার ৭২ ঘন্টা আগে রোগীর সমস্ত আসল যাবতীয় ভর্তি সংক্রান্ত রেকর্ড এবং বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট, কেস পেপার নিতে চাইলে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষকে তা তাদের দিতে হবে। অর্থাৎ এইসমস্ত কিছুই আপনার অধিকারের মধ্যে পড়ে।
দুর্ভাগ্যবশত কোন রোগীর চিকিৎসা চলাকালীন মৃত্যু ঘটলে মৃত্যু সংক্রান্ত কারন লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য থাকবে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ।ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করার সময় তাতে মৃত্যুর সম্ভাব্য কারন উল্লেখ করতে হবে এবং তার আসল কপি রোগীর আত্মীয়দের জানাতে হবে।

আপদকালীন অবস্থায় পরিষেবা পাওয়ার অধিকার
ভারতীয় সংবিধানের ২১ নাম্বার ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক ভারতবাসীর বাঁচার অধিকার আছে। আর তাই রোগীকে যদি আপদকালীন অবস্থায় কোন হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয় তখন রোগীর প্রাণ বাঁচানোর জন্য সকল প্রকার পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকবে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কতৃপক্ষ। এক্ষেত্রে প্রথমে টাকা জমা করুন তারপর চিকিৎসা শুরু হবে, এরকম আমানবিক আচরণ করতে পারবে না বেসরকারি নার্সিংহোম কতৃপক্ষ।

মত নেওয়ার অধিকার
যদি কোন রোগী হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি থাকাকালীন তার বড় কিছু রোগ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা করতে হবে বা সার্জারি বা কেমোথেরাপি দেওয়ার মত যদি কোন ব্যাপার থাকে তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিট ডাক্তার তার আগাম খবর রোগী ও তার নিকটাত্মীয়দের জানাতে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে রোগীর বা তার অভিভাবকদের অনুমতি অবশ্যই নিতে হবে। আর তা অবশ্যই লিখিত অনুমতি হবে, কোন মৌখিক অনুমতি নয়। আর তার সাথে ডাক্তার বা হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষকে এইরকম করার ফলে সম্ভাব্য কি কি ক্ষতি বা ঘটনা ঘটতে পারে তাও জানাতে হবে রোগীর অভিভাবকদের।

রোগীর এবং রোগের গোপনীয়তার অধিকার
ডাক্তারি পরিষেবা বা চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীর রোগ সম্পর্কে এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষকে। অর্থাৎ রোগীর নাম এবং রোগের প্রকৃতি এবং চিকিৎসা সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য শুধুমাত্র রোগী ও তার অভিভাবকেরা জানবে, অন্য কেউ নয়। যদি রোগী কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব হয় তবে তার বা তার অভিভাবকদের অনুমতি নিয়েই তার রোগ, চিকিৎসা সম্বন্ধে তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা যেতে পারে ।তবে তা যেন সবার সম্মতি নেওয়ার পরেই করা হয়ে থাকে।

মহিলা রোগীদের ক্ষেত্রে তারা যদি চায় তাদের চিকিৎসা যদি কোন পুরুষ ডাক্তার দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে তাহলে অন্য কোন মহিলার উপস্থিতিতে চিকিৎসা করানো তাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে।অর্থাৎ লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সম্মান রক্ষা করতে হবে চিকিৎসা চলাকালীন।

বৈষম্য না করার অধিকার
হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া রোগীকে তার রোগ, শারীরিক অবস্থা, HIV অবস্থা, অথবা তাদের লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম, জাত, ভাষাগত অবস্থান, ভৌগলিক অবস্থান, আর্থ সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী কোন প্রকার বৈষম্য করতে পারবে না হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ বা চিকিৎসায় জড়িত কোন ডাক্তার বা প্যারা মেডিকেল কর্মীরা।

রোগীর নিরাপত্তা এবং যত্নের অধিকার
রোগী হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি থাকা কালীন তার নিরাপত্তা এবং যত্নের দিকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা নার্সিংহোম উপযুক্ত পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকবে। অর্থাৎ রোগীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ অবস্থা, শৌচের যথাযথ ব্যবস্থা এবং পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষকে।

বিকল্প চিকিৎসার অধিকার যদি তা দেওয়ার উপযুক্ত পরিষেবা থাকে
অনেকসময় হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া রোগীদের যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হচ্ছে সেই পদ্ধতিতে কাঙ্খিত ফল লাভ না হলে বা রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ না করলে তার বিকল্প চিকিৎসা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে রোগীকে বিকল্প চিকিৎসা করতে বাধ্য থাকবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা নার্সিংহোম যদি তাদের কাছে সেই বিকল্প চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা বর্তমান থাকে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই আবেদন করতে হবে রোগীকে বা তার আত্মীয়দের বা অভিভাবককে। এই আবেদন লিখিত ভাবে করতে হবে।আর তারপর চিকিৎসা চলাকালীন যদি কিছু দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে সেক্ষেত্রে দায়ী কিন্তু কোন মতেই হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ থাকবে না।

দ্বিতীয় মতামত নেওয়ার অধিকার
আপনি যদি চিকিৎসা চলাকালীন আপনার রোগ সম্পর্কে বা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে আপনার চিকিৎসাকারী ডাক্তার ছাড়াও অন্য কোন অভিজ্ঞ ডাক্তার বা আপনার ভরসাযোগ্য অন্য ডাক্তারের বা অন্য হাসপাতালের মতামত নিতে চান তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি সেই মতামত নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপনার রোগ সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য এবং চিকিৎসা পদ্ধতির সম্পুর্ন বিবরণ জানাতে বাধ্য থাকবে আপনার বর্তমান পরিষেবা দেওয়া হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ। অর্থাৎ আপনি এক্ষেত্রে যে আপনার বর্তমান হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েই চিকিৎসা করাবেন বা অন্য কোথাও গিয়ে চিকিৎসা করাবেন তা সম্পূর্ণ আপনার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। এক্ষেত্রে আপনার বর্তমান হাসপাতাল বা নার্সিংহোম আপনাকে তাদের কাছেই চিকিৎসা করাতে বাধ্য করতে পারে না। তবে আপনার বর্তমান স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে আপনার পক্ষে তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে তা তারা বড়জোর জানাতে পারে।

চিকিৎসার খরচ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার অধিকার
এক্ষেত্রে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ আপনাকে তাদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পূর্বে উক্ত চিকিৎসায় যে সমস্ত খরচ হবে তার সম্পর্কে আপনাকে একটা সুস্পষ্ট ধারণা প্রথমেই জানিয়ে দেবে।অর্থাৎ চিকিৎসা করার পর তারা ইচ্ছে মতো চিকিৎসা পরিষেবা খরচ বসাতে পারবে না। তাদের খরচের বিবরণ স্পষ্ট এবং লিখিত অবস্থায় দিতে হবে। আপনার রোগ চিকিৎসা বা বিভিন্ন টেস্টের খরচ যা আপনি জমা দেবেন পরিষেবা মূল্য হিসাবে তার লিখিত রিসিপ্ট আপনি পাবেন। এটা আপনার অধিকার।
আরও পড়ুন : ভারতের সেরা ১০ টি চোখের হাসপাতাল

এছাড়াও বিভিন্ন অপারেশনের পরিষেবা খরচ ইংরেজি,এবং স্থানীয় ভাষায় স্পষ্ট উল্লেখ করে রাখতে হবে বড় কোন জায়গায় যা সহজেই সবার নজরে আসে। রোগীদের বিভিন্ন ওষুধ, বা বিভিন্ন যন্ত্র যা কিছু কিনতে হবে তার দর যেন কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত সংস্থা NPPA দ্বারা স্বীকৃত হয়।
আরও পড়ুন : হার্টের চিকিৎসায় ভারতের সেরা ১০ টি হাসপাতাল
আপনার ঔষধ ক্রয় এবং পরীক্ষা করার অধিকার
এক্ষেত্রে রোগী কোন নার্সিংহোমে ভর্তি থাকলে বা ডাক্তার দেখাতে এলে ডাক্তার যে সব ঔষধ বা টেস্ট করতে প্রেসক্রিপশন করবে তা কিন্তু সংশ্লিষ্ট নার্সিংহোমে কিনতে বা করাতে বাধ্য করতে পারে না সেই ডাক্তার।এক্ষেত্রে আপনার পছন্দের ঔষধের দোকান থেকে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আপনি আপনার টেস্ট করাতে পারেন। আপনি বড়জোর ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন কোথায় এইসব ঔষধ পাওয়া যেতে পারে এবং ভালো মানের টেস্ট কোথায় হয়? কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আপনারই।
আরও পড়ুন : পশ্চিমবঙ্গের সেরা ১০টি উচ্চমানের সরকারি হাসপাতাল
রোগী উপযুক্ত পদ্ধতিতে রেফার এবং হাসপাতাল পরিবর্তনের সময় যেখান থেকে রেফার হচ্ছে বা ট্রান্সফার হচ্ছে তাদের রোগীকে বা রোগীর অভিভাবকদের জানিয়ে দিতে হবে নতুন হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের নতুন নতুন পরিষেবা সম্পর্কে।অর্থাৎ তারা যেন জানতে পারে রোগী সেখানে গেলে আরও জীবনদায়ী পরিষেবা পেতে পারবে।
আরও পড়ুন : কলকাতার সেরা ৭টি হাসপাতাল যেখানে আপনি পাবেন সেরা স্বাস্থ্য পরিষেবা
এছাড়াও রোগীকে ট্রান্সফার করার সময় রোগীর স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন এবং কী কী উপায় অবলম্বন করলে স্বাস্থ্য আরও ভালো থাকবে, কোন কোন ওষুধ খেতে হবে তার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রোগীর আত্মীয় বা অভিভাবকদের জানাতে হবে। রোগীর অভিভাবকদের সম্মতিতেই এই ট্রান্সফার বা রেফার প্রক্রিয়া করতে হবে।
একটা রোগীকে কখনোই নার্সিংহোমে সুষ্ঠ হওয়ার পর জোর করে রাখতে পারবে না হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ। সে পরিষেবার খরচ সম্পুর্ন বা আংশিক যা মিটিয়ে থাকুক না কেন তাকে সুষ্ঠ করলে বা রোগী বা রোগীর অভিভাবকরা যদি সংশ্লিষ্ট নার্সিংহোম থেকে ছুটি চাইছেন বা রোগীকে নিয়ে যেতে চাইছেন তাহলে হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কতৃপক্ষ তা দিতে বাধ্য থাকবে। দুর্ভাগ্যবশত রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসা পরিষেবা সংক্রান্ত টাকা দেওয়া হয়নি এই অজুহাতে না র্সিংহোম কতৃপক্ষ কোন মৃত ব্যক্তিকে জোর করে হাসপাতালে রাখতে পারবে না।