মাত্র ১১ বছর বয়সে শিক্ষক! আলাপ করুন দেশের কনিষ্ঠতম শিক্ষকের সাথে

যে বয়সে শিশু বা কিশোরদের বেশিরভাগ সময়ই কাটে খেলার মাঠে বা টিভির পর্দায় কার্টুন দেখে, বা  কম্পিউটার গেমসে বা সেই মাত্র ১১বছর বয়সেই জীবনের যুদ্ধে এক কঠিন দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে চলেছে সমাজে পরিবর্তনের লক্ষ্যে এক কিশোর। না কিশোর বলা তাকে ভুল হবে, সে বর্তমানে একজন শিক্ষক। যদিও বয়স তার মাত্র ১১ বছর। কিন্তু তবুও এই বয়সে অসাধ্য সাধন করার পথে এগিয়ে চলেছে আনন্দ কুমার মিশ্র তা একপ্রকার চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর। যেখানে সবে মাত্র জীবনের শেখার পথে কয়েক কদম হয়তোএগিয়ে এসেছে আনন্দ ,সেই  বয়সেই সমাজের পরিবর্তনের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই কিশোর। শুরু করেছে এমন এক কর্মসূচি যেখানে সমাজে পিছিয়ে পড়া এবং আর্থিকভাবে অনগ্রসর  পরিবারের  ছেলে মেয়েদের শিক্ষাদানের যজ্ঞ। যাদের আনন্দ মনে করে তার ছোট ভাই এবং বোন তাদের লেখাপড়া শেখানো গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে স্বেচ্ছায় নিয়ে নিয়েছে। আর তার জন্য তাঁকে এক ডাকে সবাই চেনে “ছোট মাস্টারজি” নামে।

 

যেভাবে এই ইচ্ছা আনন্দের মনে জেগেছিল

আনন্দ  কুমারকৃষ্ণ মিশ্র বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের লখনও শহরে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। কিন্তু এ ছাত্র যখন শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন তার ভিতরের প্রতিভা যেন জেগে ওঠে। আর এই ভাবেই শিক্ষকের ভূমিকায় আনন্দ শুরু করেছে এক নতুন অভিযান যার নাম “বাল চৌপাল “।এই “বাল চৌপাল” হল শহরের সন্নিকটে বা বস্তিতে বা অন্য গ্রামাঞ্চলে যেখানে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি এবং যেখানে দিনমজুর পরিবারের বসবাস করে সেই সব জায়গার শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। আর এইরকম প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রচেষ্টা যা আজ প্রায় ১২৫ টি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দের নিজের ব্যক্তিগত উৎসাহ এবং শিক্ষাদানের ইচ্ছার জন্য।

আনন্দের পিতা-মাতা অনুপ এবং রীনা মিশ্র দুজনে উত্তরপ্রদেশ পুলিশে কর্মরত। তারা তাদের ছেলের এই অভিনব উদ্যোগ সম্পর্কে খুবই উৎসাহিত এবং তারা তাঁর ছেলের এই মহৎ কাজে সবসময় তার পাশে থাকতে চাই। তাদের মতে ” আনন্দের বয়স যখন খুব কম অর্থাৎ নয় বছর বয়স ছিল, সে তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করত, সে বছর আনন্দের বিদ্যালয় ছুটি থাকাকালীন আমরা মহারাষ্ট্রের ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে আনন্দ একটা ছোট্ট শিশুকে দেখেছিল। সেই শিশুটা পড়াশোনা করছে বইয়ের পাতা খুলে মন্দিরের এক কোণে। প্রতিবারই যখন মন্দিরের মধ্যে পূজার আরতি হচ্ছিল তখন সেই শিশু মন্দিরে প্রবেশ করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যারা আরতি এবং ভজন করছিল তাদের সাথে যোগ দিচ্ছিল গানে।পরে আরতি ও ভজন শেষ হলে আবার ফিরে আসছিল তার জায়গায় ।আমরা সেই ছেলেটিকে কাছে ডেকেছিলাম এবং জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার এখানে এভাবে থাকার কারণ সে কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। ছেলেটির শরীরে জামাটি ছেড়া ছিল এবং তা আমাদের চোখে খুব খারাপ লেগেছিল ।তাই আমরা চেয়েছিলাম তাকে কিছু টাকা সাহায্য করে দিয়ে তার জন্য  নতুন জামা প্যান্ট  কিনে দেওয়ার ।কিন্তু সে আমাদের কাছে সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছিল। তাকে যখন জোর করা হয় খুবই, সে তখন একটা কথা বলে আমাকে আমার পড়াশোনার জন্য তোমরা কি বই কিনে দিতে পারবে?

আর একথা শুনে আমরা শহর থেকে তার জন্য বই কিনে এনে দিয়েছিলাম ।এই একটি ঘটনা আমার ছেলে আনন্দের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো। তার মত বয়সের এক শিশু যদি এইরকম শিক্ষাকে আপন করে নিতে পারে তাহলে সেও কেন পারবে না এই চিন্তায় তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। তারপর আমরা যখন মহারাষ্ট্র থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসি তখন লখনৌতে আমরা আনন্দ কে নিয়ে শহরের থেকে দূরে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতে থাকি এবং আমরা দেখতে পাই আনন্দের বয়সেই অনেক শিশুই আছে যারা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ঘরের বিভিন্ন কাজ করছে বা শিশু শ্রমিক হয় টাকা রোজগারের চেষ্টা করছে।এ ঘটনা আমাদের কাছে খুব বেদনাদায়ক ছিল। আমরা অনেককে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম তারা যেন তাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট না করে এবং আমরা তাদের উৎসাহ জানানোর জন্য তাদের সবাইকে বলেছিলাম তারা যেন বিকাল দিকে একটা সময়  আনন্দের সঙ্গে কাটায় এইভাবে যখন একটার পর একটা ছেলে আনন্দের সঙ্গে বিকালের পর সময় কাটাতে থাকে তারাও আনন্দের কাছে শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন জিনিস জানতে পারে।

তাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে আর এইভাবে সে সব ছেলেমেয়েদের বন্ধুরাও আনন্দের কাছে চলে আসে ।এভাবে শুরু হয়” বাল চৌপল” শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা। আজ থেকে প্রায় ৬বছর আগে অর্থাৎ ২০১২সাল থেকেই আনন্দ এই “বাল চৌপল” ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষাদানের প্রথা চালু করে। আনন্দ তার স্কুল জীবনের সকল কিছু শিক্ষা সেসব বস্তি ছেলেমেয়েদের কাছে তুলে ধরেছিল। পরবর্তী সময়ে এই ভাবে বস্তির ছেলেদের যাদের পড়াশোনার সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক নেই তাদের কাছে আনন্দ ছুটে যেত বা ঐ সমস্ত ছেলেরা এক জায়গায় একত্রিত হয়ে আনন্দের কথা শুনতে লাগত এই ভাবেই গ্রামের পর গ্রাম ,বস্তির পর বস্তি  জুড়ে শিশুদের মধ্যে জাগিয়েছিল নতুন এক উৎসাহ, শিক্ষা গ্রহণের উৎসাহ। আনন্দ তার সারাদিনের ১ঘন্টা সময় এরকমই শিশুদের সঙ্গে কাটাই, যাদের সে কিছু শেখাতে পারেনতুন কিছু আশা জাগাতে পারে।

যে পদ্ধতিতে আনন্দ বাচ্চাদের শিক্ষা দান করে

আনন্দ বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশুনা করে লখনৌর সিটি মন্টেসরি বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন ফিরে আসার পর আনন্দ কিছুটা সময় বিশ্রাম করে নেয় এবং তারপর শুরু হয় তার শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। প্রতিদিন বিকাল ৫ টার সময় আনন্দ তার বিদ্যালয় অর্থাৎ “বাল চৌপাল “এগিয়ে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। আসলে ঠিক শিক্ষা দেওয়া নয় আনন্দকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সে শিশুদের কিভাবে শেখায়, তখন তার নিজের কথায়,” আমি শিশুদের খুব বেশি বই পড়ায় বা লিখে শেখাতে পছন্দ করি না সাধারণত গল্প বলার মাধ্যমে এবং মজার মজার খেলার মাধ্যমে আমি তাদের কাছে কোন একটা বিষয় তুলে ধরি।আমি জানি আজকালকার দিনে শিক্ষক মহাশয়ের পাঠদান হল উপদেশ যা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাই গ্রামাঞ্চলে অনেক শিশু শিক্ষা গ্রহণের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে।

তারা হয়তো বিদ্যালয় নিজেদের নাম লিখিয়ে নেয় কিন্তু প্রতিদিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার উৎসাহ তারা পায় না। আর সেই জন্য আমি আমার “বাল চৌপালে” শিশুদের মজার গল্প, মজার খেলা ইত্যাদির মাধ্যমে শেখানোর চেষ্টা করি। আমি আমার এই ‘বাল চৌপালে” থাকা আমার বয়সের বা আমার থেকে কম বয়সে ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এর মাধ্যমে শেখানোর চেষ্টা করি ,।আমাদের পাঠ্য শুরু হওয়ার আগে আমরা একটা গান গেয়ে শুরু করি, যেটি হল,” হাম হোঙ্গে কাময়াব, হাম হোঙ্গে কাময়াব, হাম হোঙ্গে কাময়াব একদিন ……এবং আমাদের পাঠ্য দান পর্ব শেষ হওয়ার পর আমরা জাতীয় সংগীত গেয়ে সেদিনে পাঠক্রম শেষ করি।  এই ভাবনা, আশা করি আমার সকল বন্ধুরা তাদের সামাজিক এবং দেশীয় কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে জানতে পারবে এইভাবেই এবং ভবিষ্যতে তারাও একজন উন্নত নাগরিক হয়ে উঠবে দেশের।

আরও পড়ুন : ১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানশিক্ষক, শিক্ষিত করেছেন ৫০০০ জন শিশুকে

আনন্দের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

এই ভাবে শিশুদের এবং তার বয়সি ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাদানের যে মহৎ কার্য আনন্দ শুরু করেছে তার ফলাফল হিসেবে পেয়েছে অনেক নাম ও খ্যাতি, আর সাথে জুটেছে অনেক পুরস্কার। যেমন উত্তর প্রদেশ সরকারের সত্য সাধন বাল রতন পুরস্কার এবং সেবা রতন পুরস্কার পেয়েছে আনন্দ। আর এই পুরস্কারের আর্থিক মূল্য দিয়ে এবং বিভিন্ন উপকারী লোকের আর্থিক সাহায্য নিয়ে আনন্দ শুরু করেছে গ্রন্থাগার খোলার কাজ। এইভাবে বিভিন্ন এলাকায় সে গ্রন্থাগার খুলে শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী ছেলেমেয়েদের উৎসাহ আরো অনেক বেশি বাড়াতে চাই ।তাই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে আছে গ্রন্থাকারে সংখ্যা বাড়ানো। যদিও আনন্দ জানে তার একার পক্ষে এই মহৎ কাজ করা সম্ভব নয়।

আর সেজন্য বিভিন্ন শিক্ষিত এবং ক্ষমতাবান নাগরিকের কাছে সে অনুরোধ করে বিভিন্ন রকম সাহায্যের জন্য ।কেউ হয়তো আনন্দর বাল চৌপালে একদিন করে এসে ছাত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে যান ,কেউ হয়তো দিয়ে যান আর্থিক সাহায্য ।আর এই ভাবে বাল  শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনরূপ বাধা থাকে না  তা আনন্দ চাই।সাধারণত তার যখন পড়াশোনার চাপ বাড়ে অর্থাৎ তার বিদ্যালয় যখন পরীক্ষা পর্ব শুরু হয় সে সময় তার এই বাল চোপাল চালানোর কাজে সাহায্য করে তার বন্ধুরা এবং তারই মত উদ্যোগী অন্যান্য ছেলেমেয়েরা। আর এভাবেই আনন্দ চাই তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান যা তিনি তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তা যেন সমাজের সকল অশিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তুলতে পারে ।ধন্য এরকম শিক্ষকদের এবং ধন্য তাদের ইচ্ছাশক্তিকে।কুর্নিশ জানাই এমন প্রতিভাকে।এইভাবেই আমরা অজ্ঞতার অন্ধকারকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলবো।তবে সবার প্রচেষ্টায় তা সম্ভব।