ভোটার কার্ড কীভাবে আবেদন, ট্র্যাক এবং সংশোধন (অনলাইন / অফলাইন) করবেন ?

গণতান্ত্রিক দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। আর এই গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের সবচেয়ে বড়  ক্ষমতা হল তারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের সরকার নির্বাচন করে একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর। আর এইজন্য ভারতীয় সংবিধানে দেওয়া হয়েছে জনগণকে এক বিশেষ ক্ষমতা। এই ক্ষমতা হল ভোট দেওয়ার ক্ষমতা। আর তার জন্য চায় প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের ভোটার কার্ড বা সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্র। অর্থাৎ সকল ভারতীয় নাগরিক যাদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হয়েছে তারা এই ভোটার কার্ড করাতে পারবেন। এটা একটা প্রাপ্ত বয়স্ক ভারতীয় নাগরিক হওয়ার পরিচয়পত্র। তাই এর গুরুত্ব সকলের কাছেই অপরিসীম। আমাদের দেশে ভোটার কার্ড করার দায়িত্ব ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের। তারাই প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেক গ্রাম থেকে শহরে অর্থাৎ দেশের প্রতিটি প্রান্তে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে এই নতুন পরিচয়পত্র তৈরির কাজ করেন। তবে ভোটার কার্ড যে শুধুমাত্র ভোট দেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয় তা শুধু নয়। এটা আপনার জন্মের, বাসস্থানের প্রমাণপত্রও বটে। এছাড়া প্রায় সবরকম সরকারি গুরুত্বপূর্ন কাজে তা ব্যাংকে নতুন খাতা খোলা হোক বা ট্রেনের টিকিট সংরক্ষণ করা। বা কোথাও ঘুরতে গিয়ে বাড়িভাড়া থেকে লজ ভাড়া নেওয়া সবের ক্ষেত্রেই এর দরকার পড়ে। এতদিন পর্যন্ত এই ভোটার কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া অফলাইনেই হত। অর্থাৎ আপনাকে সরাসরি উপস্থিত থেকে নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে তা করাতে হতো। কিন্তু বর্তমানের ডিজিট্যাল যুগে যখন সব কাজ অনলাইনে হচ্ছে, তখন ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এই ভোটার কার্ড করার কাজও অনলাইনে শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে সাধারণ গ্রামের মানুষ থেকে শুরু করে যারা সদ্য ১৮ তে পা দিয়েছে এমন তরুণ তরুণীরা আরও বেশি সহজেই তাদের সচিত্র পরিচয় পত্র তৈরির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।আর হবেই না কেন এ যে তাদের সাংবিধানিক অধিকার।

রঙিন ভোটার কার্ড

এতদিন পর্যন্ত ভারতীয় নির্বাচন কমিশন যে সব ভোটার কার্ড দিয়েছে তা সবই ছিল সাদা কালো চিত্রের ভোটার কার্ড। অর্থাৎ আপনার যে পাসপোর্ট মাপের ছবি দেওয়া হত তার ছবি রঙিন না হয়ে সাদা কালো হত। আর এই লেমিনেটেড কার্ডে থাকত আপনার নাম ,বাবার নাম ,জন্ম তারিখ, আর আপনার স্থায়ী ঠিকানার বর্ণনা। কিন্তু সাদা কালো ভোটার কার্ডে আপনার ছবি বুঝতে অনেক সময় অসুবিধা হত। তাই নির্বাচন কমিশন এই অসুবিধা দূর করার জন্য রঙিন চিত্র সহ ভোটার কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।আর তাই বর্তমানে খুব সহজেই আপনি পেতে পারেন এই রঙিন সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্র।

কীভাবে এই রঙিন ভোটের কার্ডের জন্য আবেদন করবেন ?

কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দারা যেভাবে এই সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্রের জন্য আবেদন করবেন তা হল

  • প্রথমেই আপনাকে কলকাতার যে সরকারি ওয়েবসাইট আছে তাতে ক্লিক করতে হবে।
  • তারপর তাতে আপনি পাবেন “Registration of new PVC Voter ID “বলে একটা লিংক যাতে আপনাকে ক্লিক করতে হবে।
  • এরপর আপনার সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য এখানে আপনাকে জানাতে হবে আপনার মোবাইল নাম্বার সহ।
  • এখানে আপনার রঙিন ছবি দেওয়ার জায়গায় আপনার রঙিন ছবি আপলোড করতে হবে।
  • এরপর আরও কিছু তথ্য দেওয়ার থাকলে তা দিয়ে আপনাকে “Submit” অপশন ক্লিক করতে হবে।
  • একটা ভেরিফিকেশন কোড আপনার মোবাইল নাম্বারে আসবে এরপর।সেই কোড দেওয়ার জন্য একটা শূন্যস্থান দেখা যাবে যাতে তা লিখতে হবে।
  • তারপর ওই নির্দিষ্ট সাইট থেকে একটি পরিচয় কোড পাঠাবে আপনার রঙিন ভোটার পরিচয় পত্রের জন্য।
  • আপনি এরপর আপনার দেওয়া মোবাইল নাম্বারে মেসেজ পেতে থাকবেন আপনার রঙিন ভোটার কার্ডের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ।
  • এরপর আবেদনের ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে আপনার দেওয়া ঠিকানায় ভারতীয় ডাকের সহায়তায় আপনার রঙিন ভোটার কার্ড পৌঁছে যাবে।

নতুন ভোটার কার্ডের জন্য অনলাইনে কীভাবে আবেদন করবেন ?

কলকাতার সকল নাগরিকদের জন্য ভোটার কার্ড করার কাজ যার দায়িত্বে তিনি হলেন  কলকাতার মুখ্য নির্বাচনী অফিসার। নীচে দেওয়াএই ধাপগুলি অনুসরণ করলে আপনি অনলাইনে ভোটার কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন।

  • প্রথমেই আপনাকে কলকাতার সরকারি মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের ওয়েবসাইটে যেতে হবে।
  • সেখানে আপনাকে আপনার বৈধ ইমেল আই ডি, মোবাইল নাম্বার এবং নাম দিয়ে Sign up করতে হবে।
  • ওই নির্দিষ্ট সাইট থেকে আপনার দেওয়া মোবাইল নাম্বারে একটি নির্দিষ্ট username এবং password পাঠানো হবে।
  • এবারে ওই নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট থেকে ফর্ম 6 খুঁজতে হবে।তারপর তা খুঁজে পাওয়ার পর  তাতে আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানাতে হবে।
  • সমস্ত দরকারি তথ্য দেওয়ার পর তা অনলাইনে Submit করতে হবে।
  • সাবমিট করার পর তার একটা প্রিন্ট আউট আপনার কাছে রেখে দেবেন ভবিষ্যতের প্রয়োজনের জন্য।
  • ফর্ম 6পূরণ করার সময় আপনাকে” My name is not included in the enrolled list before” অপশন ক্লিক করতে হবে এবং যে নির্বাচনী ক্ষেত্রের আপনি স্থায়ী বাসিন্দা তা সঠিক স্থানে বসাতে হবে যেহেতু আপনি প্রথমবারের জন্য আবেদন করেছেন।
  • আবেদনকারীকে তার নিকট আত্মীয় অর্থাৎ বাবা বা মায়ের নাম দিতে হবে যারা এর পূর্বে তাদের নাম সেই নির্বাচনী ক্ষেত্রের ভোটার কার্ডের তালিকায় নথিভুক্ত করিয়েছে ।
  • আবেদনকারীকে তার পরিবারের সদস্যদের নাম দিতে অবশ্যই হবে যদি তাদের নাম সেই নির্বাচনী ক্ষেত্রের ভোটার লিস্টে না থাকে তবুও।
  • আবেদনকারীকে অবশ্যই তার সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য সঠিক দিতে হবে।
  • সমস্ত তথ্য দিয়ে ফর্ম পূরণ করার পরই আবেদনকারীকে নিজের পাসপোর্ট সাইজের রঙিন বা সাদা কালো ছবি আপলোড করতে হবে নির্দিষ্ট জায়গায়।ছবি আপলোড হয়ে গেলে পুরো পূরণ করা ফর্ম ছবি সহ মনিটরে ভেসে উঠবে।এই পূরণ করা ফর্মের ছবি সহ প্রিন্ট আউট নিয়ে নিতে হবে।এরপর নিকটস্থ নির্বাচন কমিশনের অফিসে পাঠাতে হবে।এর পর দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসারেরা ওই পূরণ করা ফর্মের Section 2 অংশ পূরণ করে তা পুনরায় আবেদনকারীর ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

অনলাইনে ভোটার কার্ড সংশোধন কীভাবে করবেন ?

প্রথমেই আপনাকে কলকাতার সরকারি মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের ওয়েবসাইটে যেতে হবে।

  • এরপর ওই ওয়েবসাইটের হোম পেজে “Electoral Services”  অপশনটি সিলেক্ট করতে হবে।
  • এই অপশন সিলেক্ট করার পর সেখানেই “Apply for Correction” অপশন ক্লিক করতে হবে।
  • এই অপশন ক্লিক করার পর আপনার সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য ফর্ম 8এ গিয়ে পূরণ করতে হবে।
  • আপনাকে আপনার কাছে বর্তমানে থাকা সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের নাম্বারটি জানাতে হবে।
  • এরপর যে যে সংশোধন আপনি করতে চান, যেমন জন্মের তারিখ,নিজের নামের বানান,ছবি, স্ত্রীর নাম প্রভৃতি তা আপনাকে জানাতে হবে।এছাড়াও নিজের মোবাইল নাম্বার বা ইমেল  আই ডি ও সংযুক্ত করতে পারেন ভোটার কার্ডের সঙ্গে।
  • আপনি যদি ঠিকানা পরিবর্তন করতে চান তাহলে আপনাকে পুরাতন ঠিকানার সঙ্গে বর্তমানের ঠিকানা জানাতে হবে।আর তার প্রমানস্বরূপ উপযুক্ত তথ্য আপনাকে আপলোড করতে হবে।
  • এইসব submit করা হয়ে গেলে আপনার সংশোধনের আবেদনপত্র ভালোভাবে দেখা হবে ।এবং সংশোধিত ভোটার কার্ড আপনার বর্তমানের ঠিকানাতে পাঠানো হবে ডাকযোগে।

ভোটার কার্ড হারিয়ে গেলে কি করতে হবে ?

অনেক সময় আমাদের ভোটার কার্ড মানিব্যাগ চুরি বা ছিনতাই হওয়ার বা পড়ে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার ফলে খুঁজে পাই না।এক্ষেত্রে আপনি যেভাবে সেই পুরানো ভোটার কার্ডের নকল ভোটার কার্ড পেতে পারেন তা হল

  • ভোটার কার্ড চুরি বা হারিয়ে গেলে ,আপনাকে প্রথমেই আপনার নিকটস্থ থানা বা ফাঁড়িতে যেতে হবে অভিযোগ জানাতে।
  • তারপর আপনি আপনার ভোটার কার্ড হারিয়ে গিয়েছে বা চুরি গিয়েছে এই মর্মে একটি FIR জানাতে হবে ,সেখানে কীভাবে আপনার ভোটার কার্ড হারিয়ে গিয়েছে তার উপযুক্ত তথ্য দিতে হবে পুলিশের কাছে।এছাড়াও আপনার ভোটার কার্ডের সমস্ত তথ্য জানাতে হবে।FIR এর কপি আপনার কাছেও থাকবে ।
  • এরপর ভারতীয় নির্বাচন কমিশন কতৃক জারি করা ফর্ম 002 আপনাকে পূরণ করতে হবে।এই ফর্ম আপনি আপনার স্থানীয় BLO অফিসারের কাছে বা নির্বাচন কমিশনের শাখা অফিস থেকে বা ব্লক থেকে পেতে পারেন।
  • এই পূরণ করা ফর্ম 002 এর সাথে আপনার স্থায়ী ঠিকানার প্রমান স্বরূপ উপযুক্ত তথ্য জমা করতে হবে।
  • এইসমস্ত তথ্য ও পূরণ করা ফর্ম আপনাকে আপনার নিকটস্থ নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে জমা করতে হবে।
  • এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার আবেদনপত্র পর্যালোচনা করে আপনার ঠিকানায় নকল ভোটার কার্ড পাঠানো হবে।

অফলাইনে নতুন ভোটার কার্ড তৈরির জন্য কি কি করতে হবে ?

  • ফর্ম 6 তাদের পূরণ করতে হবে তাদের যারা প্রথমবারের জন্য ভোটার কার্ডের জন্য নাম নথিভুক্ত করছেন।
  • ফর্ম 8 তাদের পূরণ করতে হবে যারা তাদের ভোটার কার্ডের সংশোধন করতে চান ।
  • ফর্ম 8A তাদের পূরণ করতে হবে যারা তাদের ভোটার কার্ড এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করতে চান।
  • মৃত ব্যক্তির ভোটার কার্ড বাতিল করার জন্য ফর্ম 7 পূরণ করতে হবে।
  • উপরের উল্লিখিত ফর্ম আপনি আপনার স্থানীয় BLO ,বা গ্রাম পঞ্চায়েত ,বা ব্লক বা পৌরসভা ও নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।
  • নুতন নাম নথিভুক্ত করার সময় আপনাকে বয়সের প্রমানপত্র,ও ঠিকানার প্রমানপত্র জমা দিতে হবে ও  ২ কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিতে হবে ।
  • এইসব ফর্ম পূরণ ও তার সাথে দরকারি প্রমাণপত্র জমা দিলে তা খতিয়ে দেখবেন আপনার BLO ।তারপর আপনাকে একটা নির্দিষ্ট দিনের ব্যবধানে  আপনাকে আপনার নতুন ভোটার কার্ড দেওয়া হবে।

ঠিকানার প্রমাণপত্র হিসাবে যা কিছু দেওয়া হয়

  • রেশন কার্ড বা ইলেকট্রিক বিলের কাগজ বা টেলিফোন বিলের কাগজ বা ব্যাঙ্কের পাসবুকের জেরক্স বা পাসপোর্টের জেরক্স বা ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জেরক্স
  • বয়সের প্রমাণপত্র হিসাবে যা কিছু দেওয়া যেতে পারে
  • মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট বা জন্ম সার্টিফিকেট বা আধার কার্ড বা প্যান কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্ট
  • আপনার ভোটার কার্ডের বর্তমান স্ট্যাটাস কি ,তা আপনি অনলাইনে এইভাবে জানতে পারবেন
  • প্রথমেই আপনাকে কলকাতার সরকারি মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের ওয়েবসাইটে যেতে হবে।
  • এরপর ওই ওয়েবসাইটের হোম পেজে “Electoral Services”  অপশনটি সিলেক্ট করতে হবে।
  • এই অপশনে আপনি ক্লিক করবেন “Application Tracking” নামের অপশনটি
  • এরপর আপনার আবেদনপত্রের নাম্বার থেকে বা আপনার দেওয়া মোবাইল নাম্বারের মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন আপনার আবেদনপত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে।
  • আপনার আবেদনপত্র যাচাই হয়ে গেলে BLO আপনার ঠিকানায় এসে সবকিছু পুনরায় যাচাই করার পর আপনার নতুন ভোটার কার্ড কিছুদিনের মধ্যেই  আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।