ভারতীয় হিন্দুদের বিয়ের প্রথা অসাধারণ সুন্দর। অনেক আত্মিক। দুটি প্রান এক হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বন্ধন। দুটি হাত এক হল। শুভদৃষ্টি, চার চোখের মিলন। সেতু তৈরি হয়ে গেল। শুধু এক জন্মের নয়, সাত জন্মের জন্য রচিত হল বাঁধন। এইবার পথ চলা শুরু দুই জনের। অনেক অনেক প্রাচীন প্রথা আছে এই বিয়েতে। দুটো প্রাণের সঙ্গে দুটো পরিবারেরও মিলন ঘটছে। গড়ে উঠছে আত্মীয়তা। কখনও-সখনও যা রক্তের চেয়েও বেশি।
তবে বেশ কয়েকটি ঘৃণ্য প্রথাও এই বিয়ের সঙ্গে লেগে আছে। আধুনিক সমাজ যা এখনও বয়ে নিয়ে চলেছে। যেটা খারাপ সেটাকে ত্যাগ করেই কোনও জাত বা ধর্ম সভ্য হয়। আমাদের হিন্দু ধর্মও বহুবার পরিশোধিত হয়েছে। যা মানুষকে নিজের আত্মসম্মান থেকে বঞ্চিত করে তা পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়। এখানে আমরা আলোচনা করেছি সেরকমই বিয়ের কিছু প্রথা নিয়ে।
১) কন্যাদান
দুটি শব্দের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ‘কন্যা’ এবং ‘দান’। বিয়েতে পাত্রীর পিতা মেয়েকে তুলে দেবেন জামাইয়ের হাতে। এটাই দান। আসলে ‘কন্যাদান’ শব্দটি উচ্চারণেই এক ধরণের দাতা এবং গ্রহীতার সম্পর্ক তৈরি হয়। বিয়ের মতো একটি পবিত্র অনুষ্ঠানের সঙ্গে যা একেবারেই মানায় না।
এসবের সঙ্গে আছে সমাজ। এই কন্যাদান নিয়ে একটি অন্য আবহ তৈরি করেন পুরোহিত ও সমাজ রক্ষকেরা। বলা হয়, অবিবাহিত অবস্থায় মেয়ে পিতা-মাতার দায়। জামাইয়ের হাতে মেয়েকে দান মানে সেই দায় থেকে মুক্তি।
এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কুমারীত্ব, সতীত্বের মতো বিষয়গুলি। যা এতদিন পিতা-মাতা রক্ষা করেছে। এবার জামাই রক্ষা করবে। ভরণ পোষণের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সতীত্বকে। এই দান শব্দ নিয়েই যত গণ্ডগোল। কন্যা বা মেয়ে যেন কোনও বস্তু। যা কাউকে দেওয়া যায়, ভাগ করা যায়। একজন নারীর কাছে এর থেকে বড় অসম্মানের আর কিছু হতে পারে না।
আজকের দিনের সভ্য সমাজে নারীকে নিয়ে মন ভাবনা কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। এর থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসাই মঙ্গলের।
২) কাশীযাত্রা
এই প্রথার চল দক্ষিণ ভারতে। এখন অবশ্য এই প্রথা নিয়ে মজার ভাগটাই বেশি। তবে তামিল সংস্কৃতিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথা অনুযায়ী, বিয়ের মাঝপথে পাত্র উঠে পড়ে এবং বিয়ে করতে অস্বীকার করে। জানিয়ে দেয়, সে সমস্ত পার্থিব আনন্দ ত্যাগ করেছে। এখন ধর্ম পাঠ করে কাটাতে চায়। ছাতা, লাঠি আর ঝোলায় চাল, ডাল নিয়ে পাত্র মণ্ডপ ছাড়ার উদ্যোগ নিলে পাত্রীর পিতা এসে তাঁকে আটকাবেন। বিবাহিত জীবন এবং তপস্বীর জীবনের পার্থক্য বুঝিয়ে তাঁর মেয়েকে সঙ্গে নিতে বলবেন। জানাবেন, জীবনের যে কোনও ওঠা পড়ায় এই মেয়ে তাঁর সঙ্গী হবে। তখন পাত্র বিয়েতে রাজি হবেন। এবং আবার বিয়ে শুরু হবে।
নিছক মজা! কিন্তু আধুনিক মননের কাছে প্রশ্ন জাগে, শুধু পাত্র কেন? ধর্ম পাঠে পাত্রী কম যায় না কি! পড়াশোনায় তারও সমান অধিকার আছে। আর পাত্রের জীবনের ওঠা পড়ায় পাত্রীকে থাকতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? এক নারী তাঁর জীবন নিয়ে কী করবেন সেটা তিনি বুঝে নেবেন। অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন কেন?
তাই মজা অন্য কিছুতে হোক। নির্দোষ মজা। যেখানে একজনের ভালো মন্দের সঙ্গে অন্যের জীবন জড়াবে না কোনোভাবে।
৩) পা ধোয়া
এটা অত্যন্ত কুরুচির প্রথা। পাত্রীর মা কিংবা পিতা বর অর্থাৎ পাত্রের পা ধুইয়ে দেবে। অনেক জায়গায় পাত্র নিজেই পা ধুয়ে নেয়। এটা বহু প্রাচীন একটি প্রথা। একসময় পাত্র অন্য গ্রাম থেকে হেঁটে বিয়ে করতে আসতেন। এখন সেই দিন গিয়েছে। তাহলে পুরনো এই প্রথাকে আঁকড়ে থেকে লাভ কি? আসামে কন্যার দিদিকে পাত্রের পা ধুইয়ে দিতে হয়।
এটা দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে অসম্মান করা। আর যদি প্রথার ওপরেই শ্রদ্ধা থাকে তবে পাত্রীর পা কি দোষ করল? পাত্রীর দুই পাও জলে ধোয়া হোক। নতুবা বন্ধ হোক এই প্রথা।
৪) বিয়ের হলুদ
পাত্র ও পাত্রী উভয়কেই মাখানো হয় হলুদ বাটা। অবিবাহিত অবস্থায় শেষবার পরিবারের সঙ্গে কাটানোর স্মৃতি বহন করে এই প্রথা। কিন্তু বাঙালি বিয়েতে এর একটা অন্য দিক আছে। এই হলুদ আগে মাখানো হয় পাত্রকে। তারপর সেই হলুদ বাটাই যাবে কন্যাপক্ষের বাড়ি। এবং সেটা মাখানো হবে পাত্রীকে। এই প্রথায় যৌনতার উদযাপন আছে। কিন্তু আজকের দিনে এটা কতটা স্বাস্থ্য সম্মত সেই দিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজন আছে।
মূল বিষয় কুদৃষ্টি থেকে পাত্র ও পাত্রীকে বাঁচানো। তাহলে আলাদা হলুদ বেটেই তো সেই কাজ করা যেতে পারে।
৫) নাম পরিবর্তন
শুধু পদবি নয়। উত্তর ভারত এবং পশ্চিমের অনেক এলাকাতেই বিয়ের পর মেয়ের নামটাই পাল্টে দেওয়া হয়। স্বামীর কুষ্ঠি বিচার করে যে নামটি উপযুক্ত সেটি রাখা হয় পাত্রীর নাম। আর পাত্রের পদবী হবে শেষ নাম।
নাম বদল মানে একজনের অস্তিত্ব বদলে দেওয়া। নামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় জড়িয়ে আছে। এক ধাক্কায় সেই পরিচয় মুছে দেওয়া হল। একজন মানুষের সঙ্গে এ কি ব্যবহার? আর সব ভাগ্য গণনা কেন পাত্রের বেলায়? নাম পাল্টাতে হলে কিছু দায় পাত্রও নিক। সেটি হবে না। শিক্ষিত সমাজে শুধু জ্যোতির্বিদ্যার ওপর ভরসা করে একজনের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।
আরো পড়ুন : যে ১০ ক্রিকেটার দু’বার বিয়ে করেছেন
৬) গাছ বা কুকুরের সঙ্গে বিয়ে
এই প্রথা পাগলামির সমান। পাত্রী মাঙ্গলিক হলে পিপুল গাছ বা কুকুরের সঙ্গে প্রথমে তার বিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় বিয়ের মূল অনুষ্ঠান।
মনে করা হয়, মেয়ের মাঙ্গলিক থাকলে পাত্রের মৃত্যু তাড়াতাড়ি হয়। তাই দোষ কাটাতে গাছ বাঁ অন্য প্রানীর সঙ্গে বিয়ে। এর থেকে মর্মান্তিক আর কিছু হয় না। এই প্রথা সমাজের ভণ্ডামিটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একদিকে ‘জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে’ মানা হলেও মাঙ্গলিক মেয়ের দোষ খণ্ডাতে হয়। এই প্রথা শুধু মুর্খামি নয়, নারীকে চরম অপমান করা হয়।
৭) কলসি ভারসাম্য
এই প্রথার চল বিহারে। কন্যা বিয়ের পর ছেলের বাড়িতে ঢুকলে তার মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয় কলসি। পাত্রী ওই কলসি মাথায় হাঁটবে। সেটা পড়ে গেলে হবে না। কিছু সময় অন্তর চাপান হতে থাকবে আরও কলসি।
বিশ্বাস, পাত্রের উচ্চাকঙ্খা চরিতার্থ হয় এতে। কর্মজগত এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারে। বুঝুন কাণ্ড! তবে পাত্রও দু-একটা কলসি মাথায় ব্যলান্স দেখাক।
আরো পড়ুন : ১০ মুসলিম সেলিব্রিটি যারা একজন হিন্দুকে বিয়ে করেছেন
৮) মা নয়
বাঙালি বিয়ের একটি ‘কু’প্রথা। নববধূর মা থাকতে পারেন না বিয়ের সময়। এতে না কি মেয়ের ভবিষ্যতের ওপর খারাপ দৃষ্টি পড়ে। পাত্রের মা’ও থাকতে পারেন না বিয়েতে। অজুহাত সেই এক। এখনও এই প্রথা চালিয়ে যাবার কোনও অর্থ নেই বলেই মনে হয়।
আরো পড়ুন : দ্বিতীয় বিয়ে না করলে বাবা হতে পারেন না এই গ্রামের পুরুষেরা
৯) পুরুষদের জন্য খাবার
এই প্রথা অবশ্য ‘রাভা’ উপজাতির মধ্যে চালু। বিয়ের পরদিনই বাড়ির পুরুষদের জন্য পঞ্চ ব্যাঞ্জন রাঁধতে হয় নববধূকে। অন্যান্য জায়গায় শুধু মিষ্টিটুকু রাঁধলেই চলে। অবশ্য এই রান্নায় পাত্রীর কোনও ভাগ নেই। বাড়ির পুরুষেরাই এটা চেখে দেখতে পারেন।
১০) মঙ্গলসূত্র এবং বাঙালি
এটা বিয়ে হয়েছে তার চিহ্ন। অবশ্য এই চিহ্ন শুধু পাত্রীকেই ধারণ করতে হয়। পাত্রকে নয়। ভারতে কনেকে পরানো হয় মঙ্গলসূত্র বা থালি। বাঙালি বিয়েতে কনেকে দেওয়া হয় শাঁখা-সিঁদুর। সঙ্গে নোয়া। অনেক জায়গায় পায়ে রিং পড়ানো হয়। এবং কোনওটাই পাত্রী আর খুলতে পারবে না কোনওদিন। অবশ্য পাত্রের জীবন যেমন ছিল তেমনই থাকে। তাকে কিছু ধারণ করতে হয় না। বিবাহিত জীবনের প্রমাণ দেবার দায় পাত্রের নেই।
আরো পড়ুন : প্রেম করে বিয়ের ১০টি সুবিধা ও অসুবিধা
এইভাবে বিবাহের লক্ষণ হিসাবে কোনও কিছু দেগে দেওয়া অনুচিত। অন্তত এই আধুনিক সমাজে এই প্রথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিলুপ্ত হোক।
আসলে বিয়ে মানেই পাত্রী বা পাত্রীর পরিবারকে কিছু সম্মান বলি দিতে হবে। বিয়ের মতো সুন্দর একটি প্রথায় এমন অসঙ্গতির কালি লাগানো অনুচিত। পাত্র ও পাত্রী উভয়কেই সমান সম্মান দেওয়া হোক। নতুন জীবনে প্রবেশের আগে এর থেকে বড় চাওয়া আর কি হতে পারে?
আমাদের প্রতিটি পোস্ট WhatsApp-এ পেতে ⇒ এখানে ক্লিক করুন