দীপাবলি কি এবং কেন? অনান্য ধর্মে কিভাবে দীপাবলি পালন করা হয়?

আজ  সারা ভারত তথা বিশ্বজুড়ে পালিত হয় দীপাবলি উৎসব। এই উৎসব প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতে মহা ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। এছাড়াও সমগ্র ভারত জুড়ে  ধর্ম, বর্ণ,জাতি নির্বিশেষে এই উৎসব পালন করে থাকে। এই উৎসব কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের উৎসব না থেকে থেকে বর্তমানে একটি “আন্তর্জাতিক” উৎসবে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ ধুমধামের সঙ্গে এই উৎসব পালন করে থাকে। সকল ভারতবাসীর কাছে তথা বিশ্ববাসীর কাছে দীপাবলি হল আলোর উৎসব।
দীপাবলি  কথাটি এসেছে” দীপ” এবং  “ওয়ালি”এই দুই শব্দের সন্ধি করে।দীপ কথার অর্থ প্রদীপ এবং ওয়ালি কথার অর্থ সারি ।অর্থাৎ দীপাবলি কথার অর্থ প্রদীপের সারি ।সারি সারি প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ির এবং চারপাশের  সকল অন্ধকার দূর করা হয় এই উৎসব উপলক্ষে।

দীপাবলি কি এবং কেন? অনান্য ধর্মে কিভাবে দীপাবলি পালন করা হয়?

দীপাবলির আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা

প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে থাকে নানা রকম অন্ধকার। সেই অন্ধকার সৃষ্টি হয় বিভিন্ন কারণে ।যেমন লোভ,লালসা, মোহ, মায়া, মমতা, মাৎসর্য,এবং কামের মাধ্যমে হতে পারে। তেমনি অর্থ, ধন ,প্রভাব-প্রতিপত্তি খ্যাতি এই সকল কিছুর ফলে আমাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় নেয় অহংকার যা একপ্রকার নেগেটিভ এনার্জি ।এই অহংকারের অন্ধকার আমাদের চারিত্রিক উন্নতিতে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।আর তাই দিপাবলী উৎসবে  গৃহে প্রদীপ জ্বালিয়ে  বাড়ির মধ্যে অন্ধকার দূর করার পাশাপাশি মনের গভীরে সকল অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করা হয় ।যাতে আমরা আমাদের পথে এগিয়ে যেতে পারি কোনরূপ অহংকার বা অন্য কিছু চারিত্রিক অধঃপতন ছাড়াই । এছাড়াও  নিরক্ষরতা অন্ধকারকে দূর করতেও জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালাতে উৎসাহিত করা হয় দীপাবলি উৎসবের মাধ্যমে।তমশাময় নিশীতে একটা প্রদীপের আলোই যথেষ্ট হয় মনে সাহস জোগানোর জন্য।তেমনি শত শত প্রদীপের আলোয় আমরা আমাদের মনে সাহস ফিরে পাই।কাঙ্খিত লক্ষ্য ফিরে পেতে সাহায্য করে এই প্রদীপের আলো।

দীপাবলি কি এবং কেন? অনান্য ধর্মে কিভাবে দীপাবলি পালন করা হয়?

দীপাবলির পৌরাণিক ব্যাখ্যা

রামায়ণ অনুসারে রামচন্দ্র পিতার আদেশ রক্ষা করার জন্য চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে গিয়েছিল সীতার সঙ্গে।সঙ্গে গিয়েছিল ভ্রাতা লক্ষণ।আর তারপর ঘটনা পরম্পরায় রাক্ষস রাজ লংকেশ রাবণ সীতাকে হরণ করে সোনার লঙ্কায় নিয়ে যায়।রাম সীতাকে ফিরে পাওয়ার জন্য রাবনের  সঙ্গে লড়াই করে তাকে হত্যা করে হনুমান ,বিভীষণ,বানর রাজা সুগ্রীব এবং অন্যান্য বানর সেনার সাহায্য নিয়ে।আর তারপর তার প্রানের প্রিয়া সীতাকে ফিরে পান।আর আজ আমরা যেদিন দীপাবলি উৎসব পালন করছি ত্রেতা যুগে সেই দিনে পুনরায় অযোধ্যায় ফিরে আসেন ।আর এই উপলক্ষ্যে অযোধ্যাবাসী তাদের প্রিয় রামকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে সেই বিশেষ রাত্রে রাজ্যজুড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব পালন করে । এই বিশেষ দিনে এছাড়াও তারা সেই নানা শব্দবাজি বা ফটকা ফোটান এবং রং মশাল জ্বালান।আর তাই এই শুভ দিনকে প্রত্যেক বছর মহা ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হতে থাকে।যা পরবর্তীতে সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও পুরাণ মতে অনেকেই মনে করেন আজকের দিনে দেবী লক্ষী পালন কর্তা বিষ্ণুর  সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিল।তাই অনেক হিন্দু বাড়িতে দীপাবলির দিনে বাড়িতে লক্ষী নারায়ণের পূজাও  হয়ে থাকে।অন্য মতে এই দিন মা লক্ষী জন্মগ্রহণ করেন।আর তাই বাড়িতে মা লক্ষীর শুভ আগমনের জন্য এই দিন মা লক্ষীর পূজা করা হয়।
এছাড়াও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এইদিন নরকাসুরকে বধ করেছিলেন তাই ভারতের অনেক অংশে বিশেষ করে গোয়ায় এইদিন কাগজ, বাজি ও খড় দিয়ে বিশালাকার নরকাসুর বানানো হয় এবং দহন করা হয় উৎসবের মতো করে আনন্দের সঙ্গে।

শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য

এই বিশেষ দিনে শিখ ধর্মগুরু হরগোবিন্দজি যিনি স্বেচ্ছায় এক বছরের মতো সময় ধরে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি মুক্তি পান।তবে তিনি নিজের মুক্তির পরেও কারাগার ত্যাগ করে যেতে অস্বীকার করেন এবং শর্ত রাখেন তার সঙ্গে আরও  যে ৫২টি হিন্দু রাজাকে মুঘল সম্রাট বন্দী করে রেখেছে তাদেরও মুক্তি দিতে হবে।মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তার এই শর্ত মেনে নেন এবং তার সাথে ৫২জন হিন্দু রাজদেরও মুক্তি দেন এই বিশেষ দিনে।তাই এই দিনটি শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি স্মরণীয় দিন।তারা এই দিনটি মহা ধুম ধামের সঙ্গে” বন্দী ছোড় দিবস” হিসাবে পালন করে।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে

এই বিশেষ দিনে বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভের জন্য তার গৃহ ত্যাগ করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন।আর তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই দিন প্রদীপ জ্বালিয়ে বা মোমবাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধদেবকে স্মরণ করা হয়।

জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে

এই বিশেষ দিনে ৫২৭অব্দে জৈন ধর্মের প্রচারক এবং প্রবর্তক  মহাবীর নির্বাণ বা মোক্ষ লাভ করেন।তাই এই দিনটি জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা  প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোক সজ্জা করেন।

আরও পড়ুন : মা কালীর জিভ বেরিয়ে থাকে কেন? কালীর পায়ের নীচে শিব থাকে কেন?

এছাড়াও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকে মনে করেন পিতৃ পুরুষগণ এইদিনে যম লোক ছেড়ে স্বর্গলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন আর তাই তাদের যাত্রাপথের অন্ধকার দূর করার জন্য প্রদীপ এবং ফটকা এবং রং মশাল জ্বালানো হয়। এছাড়াও অনেক জায়গায় ফসল উৎপাদনের উৎসব হিসাবেও পালন করা হয়।

আরও পড়ুন : পশ্চিমবঙ্গের ৭টি জাগ্রত কালী মন্দির; যেখানে গেলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবেই

তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আসুন মেতে উঠি আজকের শুভ দীপাবলি উৎসবে এবং সকল প্রকার ধার্মিক গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হারিয়ে সংহতি এবং ভাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তুলি এই উৎসবের মাধ্যমে। সকলকেই জানাই “ইচেরপাকা মিডিয়া”র পক্ষ থেকে দীপাবলির আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।