২০১৭ সালের ২০শে মে, বারাসাতের মাত্র ১৮ বছর বয়সী সেই মেয়েটি যেদিন প্রথম ইউটিউবের প্ল্যাটফর্মে ভিডিও আপলোড করেছিল, সেদিন সে নিজেও জানতো না যে খুব তাড়াতাড়িই বাঙালি মহিলা ইউটিউবার হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে চলেছে। নাম তার ইন্দ্রানী বিশ্বাস। তবে এখন আর এই নামে তাকে চেনেন না কেউ। ইউটিউবের দৌলতে সে এখন “মুন্না” হিসেবেই সকলের কাছে পরিচিত। তার চ্যানেলের নাম “ওয়ান্ডার মুন্না”!
ইউটিউবে মজার মজার ভিডিও আপলোড করে “ওয়ান্ডার মুন্না”। কখনও তাকে দেখা যায় মায়ের অবতারে, কখনও বা বাবা, কখনও জেঠু, দাদু, জেঠিমা আরও কত কি অবতারে সে ধরা দেয় ক্যামেরার সামনে। তার চ্যানেলে সে একাই একশো। দৈনন্দিন জীবনে ঘটে চলা খুঁটিনাটি মজার মজার বিষয়বস্তু নিয়েই কনটেন্ট বানায় মুন্না। প্রতিবার মজার মজার কনটেন্ট নিয়ে ওয়ান্ডার মুন্না আসে ক্লান্ত-অবসন্ন মানুষের জীবনে এক মুঠো হাসির সন্ধান দিতে।
মুন্নার ভিডিওতে আর কেউ থাকুন বা না থাকুন, মায়ের চরিত্রটি সব সময় থাকে। মায়ের সাথে মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে অনেক মজার মজার ভিডিও দর্শককে উপহার দিয়েছে মুন্না। মা-মেয়ের খুনসুটির সেই ভিডিওগুলি দেখে অনেকেই বাস্তবের সঙ্গে ঘটনাগুলির সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। মুন্নার এই ভিডিও দেখলে বোঝাই যায় যে মায়ের সাথে তার সম্পর্ক কতটা গভীর! সেই গভীর সম্পর্কের এবার ইতি হলো। সম্প্রতি মাতৃহারা হয়েছেন ইন্দ্রানী বিশ্বাস।
দীর্ঘদিন ধরেই তার মা Dementia রোগে ভুগছিলেন। যে রোগে ভুগলে মানুষ ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। শারীরিকভাবে প্রতিনিয়ত দুর্বল হতে হতে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে! ইন্দ্রাণীর মা সেই দুরারোগ্য রোগেরই শিকার হয়েছিলেন। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই ইন্দ্রাণী তার মাকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর পথে এগিয়ে যেতে দেখেছেন। তিনি এবং তার পরিবার সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। অবশেষে সেই দিনটি চলেই এলো।
“Dementia-শব্দটা যখন প্রথমবার ডাক্তারের থেকে শুনে সঙ্গে সঙ্গেই গুগল করতে শুরু করেছিলাম। স্ক্রিনে ভেসে আসা রেজাল্টগুলো আমার ভিতরে তখন ভূমিকম্প, একের পর এক আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছি আমার সমস্ত সাহস, সমস্ত বিশ্বাস…”, মায়ের মৃত্যুর পর আজ তার সেই দিনের কথাগুলোই বারবার মনে পড়ছে। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, ওষুধ তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারবে না। তবে লড়াইয়ের মেয়াদটা হয়তো বাড়বে।
ডাক্তারের কথাই সত্যি হয়েছে। এ এমন ভয়ঙ্কর রোগ যে ধীরে ধীরে তিনি নিজের অস্তিত্বই ভুলে গিয়েছেন। একসময় যিনি, রান্না-বান্না, উল-বোনা, কাঁথা-স্টিচ, বাজারে দরদাম করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে সব ভুলে গিয়েছেন। তবে তিনি কখনোই নিজের “ওয়ান্ডার মুন্না”কে ভুলে যাননি। ভিডিও শুটিং সেরে মুন্না যখনই তার মায়ের কাছে ফিরেছেন, মা তাকে ঠিকই চিনতে পেরে দুই হাতে জড়িয়ে আদর করে বলেছেন, “আমার ওয়ান্ডার মুন্না!”
মায়ের মৃত্যুর পর আজ ইন্দ্রানীর তাই প্রতি মুহূর্তেই সেই কঠিন সংগ্রামের দিনগুলির কথা মনে পড়ছে। তিনি জানতেন, মাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। “আমার প্রাণবন্ত মা সব ভুলে শুধু উদাস চোখে একদিকে চেয়ে থাকত। কোথায় সেই উলবোনা, গুজরাটি স্টিচ… কোথায় সেই শুঁটকি ভর্তা… সব গিলে খেল Dementia। মাঝে মাঝে মা বলত-কবে যাব বল তো তোমার বাবার কাছে…”, বেদনাতুর স্মৃতি মুন্নাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বর্গীয় মায়ের কাছে তার একটাই আবদার, “ভালো থেকো মা, তোমার ওয়ান্ডার মুন্নার মাথায় আদরের হাতটা রাখতে আর কোনওদিন ভুলে যেও না”।