মানুষ তার কর্মের মাধ্যমেই অমরত্ব লাভ করে।তার কর্মের মাধ্যমেই বিশ্বে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।আর এই কর্মের মাধ্যমেই যে সকল মানুষ দেবতুল্য সম্মান লাভ করে তাদের মধ্যে আছে অনেক সাধারণ মানুষ। যারা লোক চক্ষুর আড়ালে থেকেই তাদের কাজ করে যান প্রতিনিয়ত। বয়স যাদের কাছে শুধুমাত্র একটি সংখ্যামাত্র। আর এরই উজ্জ্বল উদাহরন হলেন আমাদের বাংলার বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী সুধাংশু বিশ্বাস। তার কর্মের প্রতি ভালোবাসা আর মানুষের উপকারের ইচ্ছা তাকে আজও রেখেছে যুবকের হৃদয়ের মতো প্রাণবন্ত। তার জীবনের কাহিনী আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। ভালো কিছু করার ইচ্ছা থাকলে তার জন্য যে শুধু মাত্র টাকা থাকতে হবে তা কিন্তু নয়, চায় আমাদের মনের সদিচ্ছা।আর তাই ৯৯ বছর বয়সেও তিনি এখনও বিলিয়ে দিচ্ছেন তার ভালোবাসা। তার শরীরের মধ্যে বয়সের ছাপ দেখা গেলেও তিনি আজও এতটুকুও বার্ধক্য আনতে দেয় নি তার মনে। আর তাই এই বর্ষীয়ান মহান বাঙালীকে ভারত সরকার সম্মান জানিয়েছে পদ্মশ্রী পুরস্কারে।তিনি এই বছর তার জীবনভর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন।আর আমরা সাধারণ মানুষেরা জানতে পেরেছি এই অসাধারন মানুষের জীবনের কথা।যা আমাদের জোগাবে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা।

১৯১৮সালে জন্ম এই মহান মানুষটির পরাধীন ভারতের দক্ষিণ ২৪পরগনার রামকৃষ্ণপুর গ্রামে।সেই সময় ভারত ইংরেজদের অধীনে।ছোটবেলা থেকেই তার পরিবারের ছিল সেবামূলক কাজের প্রতি এক সহজাত ইচ্ছা।কারণ তার পরিবার প্রথম থেকেই রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম ও তাদের কাজের সাথে যুক্ত ছিল।তার কথায়,”আমাদের পরিবার খুব সাধারণ জীবন যাপন করত, কারণ আমরা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম ছোট থেকেই। তবে শিক্ষার জন্য আমার পরিবার ছিল আধুনিক মনস্ক।তাই আমাকে ভালোভাবে পড়াশোনা করার জন্য কলকাতায় আসতে হয়েছিল।আর তখন কলকাতায় স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন চলছে পুরোদমে।আর তাই আমি নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে বন্দী রাখতে পারি নি।বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের আহ্বানে আমরাও জড়িয়ে পড়েছিলাম দেশ মাতাকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে।আর এই লড়াইয়ের সুবাদেই জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ও বিনোবা ভাবের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল আমার।কিন্তু একটা আক্ষেপ আমার এখনও রয়ে গিয়েছে বীর নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ আমার হয় নি, যদিও অনেকবার আমি চেষ্টা করেছিলাম।তবে দেশ স্বাধীন করার আন্দোলনে আমি কারাবরণ ও করেছি।২৯ দিন আলিপুর জেলে থাকার পর আমি আমার সাথীরা জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম।তারপর বেশ কিছুদিন আমরা আত্মগোপন করে কাটিয়েছিলাম।

তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর,১৯৫০-৫১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের একান্ত অনুগামী রামানন্দের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ হয় আর তিনি আমার জীবনে এনেছিলেন এক আশ্চর্য পরিবর্তন।তিনি আমাকে মানুষের সেবা করার জন্য আহ্বান জানান।আর তার পর থেকেই আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।দুর্বার গতিতে আমি সামনে এগিয়ে গিয়েছি।আর তাই ওই দশকেই আমি সুন্দরবন ও তার সংলগ্ন এলাকায় ১৬টির মতো আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলাম যেখানে সাধারণ ঘরের ছেলেরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে প্রকৃতির সান্নিধ্যে।

তবে তারই মাঝে আমি প্লাস্টিক তৈরির ব্যবসার সাথেও যুক্ত হয়েছিলাম।কিন্তু আমার মন এই কাজে সায় দেয় নি।মানুষের মঙ্গল করার মাধ্যমে যে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করা যায় তার লোভ আমি আর সামলাতে পারি নি।তাই দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের কল্যাণের জন্য আমি সবার সহযোগিতায় আশ্রম গড়ে তুলেছি যাতে তারা পাই ন্যুনতম দুইবেলা খাবার ও তার সাথে সৎ পথে বাঁচার মতো পুঁথিগত শিক্ষা।আর তাই আমার ব্যবসায়ের অর্জিত টাকা আমি আমার আশ্রম ও অন্যান্য কাজে খরচ করেছি।আর তারপর ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলে আমি দুঃস্থ মহিলা ও পুরুষদের জন্য এক আবাসিক প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলাম।কিন্তু আমার গ্রামের কথা ভেবেই আমার মন সব সময় চঞ্চল হয়ে উঠত।আর তাই ১৯৭৩ সালে আমি আমার গ্রামে ফিরে আসি ও সেখানে আমার পৈতৃক জমির উপর ২.৫ কাঠা জমির উপর একটি আশ্রম গড়ে তুলি।

আর আজ এই আশ্রমের জায়গা প্রায় ৩৯ বিঘাতে পরিণত হয়েছে।এখানে আমি চেষ্টা করি দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের শিক্ষার সাথে সাথে পুষ্টিযুক্ত খাবার দেওয়ার ।তারা যাতে যতটা সম্ভব আনন্দে থাকতে পারে তার দিকেও আমরা নজর রাখি।আমি মনে করি সমাজের পরিবর্তন ও দেশের পরিবর্তন শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব।আর তাই আমি ও অন্যান্য সকল ব্যক্তি যারা এই মহান কাজে যুক্ত তারা সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা করে যায় । পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের খাবার ও শিক্ষা দিয়ে বড়ো করে তোলা হয় তাদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আমাদের আশ্রমেই শিশুদের শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হয়।তারপর তাদের স্থানীয় দুর্গাপুর কৃষ্ণচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় ও বারু উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়।আমাদের এখানে যদিও মেয়ে শিশুদের রাখার মতো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের রাখতে পারি নি। বর্তমানে তার আবাসিক আশ্রমে ৫০ জন শিশু ও ৬ জন প্রবীণ নাগরিক থাকেন ,তবে তা পরবর্তীতে ১০ জনের মতো রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।”

আর তার এই আশ্রমের পরিচালনার দায়িত্বে আছে ১৫ জনের এক বিশেষ কমিটি যেখানে আছেন এস. কে.বাগচীর মতো একজন ডাক্তার আবার আছেন অশোক বসুর মতো একজন অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ।তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর সরকার ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তার এই আশ্রম যেন আমাদের মানব সেবার যে পরম উপকার তার প্রত্যক্ষ ফল উপলব্ধি করতে সাহায্য করছে।
“জীব সেবাই যে শিব সেবা” তারই প্রকৃত সাধক আমাদের চির নমস্য এই সুধাংশু বিশ্বাস।