হিন্দু ধর্মের অন্যতম শক্তিশালী দেবতা শিব। সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা। পুরাণ মতে, হিমালয়ের কৈলাসে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর অবস্থান। আদ্যাশক্তি দেবী পার্বতীর স্বামী ও গণেশ-কার্তিকের পিতা শিব। লিঙ্গ রূপে পূজিতা হন তিনি। সন্ন্যাসীর জীবন তাঁর। যা সংযম ও ত্যাগের প্রতীক। এখানে আমরা বেছে নিয়েছি সর্বশক্তিমান শিব সম্পর্কে ২০টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
১। দেবী পার্বতী শিবের দ্বিতীয় স্ত্রী। রাজা দক্ষ প্রজাপতির মেয়ে সতীকে প্রথম বিয়ে করেন তিনি। পিতার মুখে পতি-নিন্দা শুনে দেহ ত্যাগ করেছিলেন সতী দেবী। এরপরে এক ব্রাক্ষ্মণের কথায় শিব বিয়ে করেন পর্বতরাজের কন্যা পার্বতীকে। পার্বতীকে আদ্যাশক্তি, গৌরী, ঊমা, অপর্ণা নামেও ডাকে হয়। বিশ্বাস দেবী সতীরই আর এক রূপ পার্বতী।
২। হিন্দুদের অন্যতম শক্তিশালী দেবতা শিব বেদে রুদ্র নামে খ্যাত। তিনি সর্বশক্তিমান ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বরের অংশ তাই মহেশ নামেও তিনি পরিচিত। শিবের দুই পুত্র, কার্তিক ও গণেশ। দক্ষিণ ভারতের বহু স্থানে কার্তিকের মন্দির আছে। মুরুগান নামেও ডাকা হয় তাঁকে।শিব শরীরে ছাই-ভস্ম মাখেন। গলায় পড়েন হাড় আর খুলির মালা। গাঁজা আর ভাং খেতে পছন্দ করেন।
৩। শিবের শরীর পাঁচটি মন্ত্র দ্বারা গঠিত। এগুলিকে বলা হয় পঞ্চব্রহ্মণ। দেবতা রূপে এই পাঁচটি মন্ত্রের নিজস্ব নাম ও মূর্তিতত্ত্ব বর্তমান: সদ্যোজাত, বামদেব, অঘোর, তৎপুরুষ, ঈশান
৪। শিবের কনিষ্ঠ সন্তান গণেশ। স্নানে ঢোকার আগে শরীরের ময়লা দিয়ে গণেশকে তৈরি করেন পার্বতী এবং বলে যান পাহারা দিতে। সেইসময় সেখানে উপস্থিত শিব। গণেশ তাঁকে ঢুকতে বাঁধা দিলে বেঁধে যায় হুলস্থুল। গণেশের মুন্ডুচ্ছেদ করেন ক্রুদ্ধ শিব। সন্তানের কাটামুন্ডু দেখে রেগে যান পার্বতী। শেষে ভুল বুঝতে পারেন শিব। এবং কাটা মুন্ডুর জায়গায় স্থাপন করেন হাতির মাথা। সকল দেব-দেবী উপস্থিত থেকে আশীর্বাদ করেন গণেশকে। ঘটনার খেসারত হিসাবে ঠিক হয়, সবার আগে পুজো হবে গণেশের।
আরো পড়ুন : কীভাবে শুরু হয়েছিল শিবরাত্রি ব্রত? জেনে নিন পুরো কাহিনী
৫। সমুদ্র মন্থনে উঠে আসা বিষ গলায় ধারণ করে জগত রক্ষা করেন শিব। তাই তাঁর আরেক নাম নীলকণ্ঠ।কৈলাসে তার ভক্ত ও অনুসারীদের নিয়ে সপরিবারে বসবাস করেন শিব। তাঁর বাহন ষাঁড়। যা জ্ঞান ও ধর্মের প্রতীক।
৬। প্রতি বছর হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি উৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসব হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দিন ভক্তের শিবের মস্তকে ফল, ফুল ও বিল্বপত্র অর্পণ করে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাংলায় শিবকেন্দ্রিক একটি বিশেষ উৎসব পালিত হয়। এটি চড়ক উৎসব নামে পরিচিত। এটি পৌরাণিক উৎসব নয়, লোকউৎসব। গাজন এই উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৭। গঙ্গাকে নিজের জটায় ধারণ করেন শিব। মানুষের কল্যাণের জন্য গঙ্গাকে মর্ত্যে আনতে চান ভগীরথ। পথে শিব আটকে দেন। নিজের জটায় জড়িয়ে নেন গঙ্গাকে। ভগীরথ শিবের তপস্যা শুরু করেন। তুষ্ট শিব পথ ছেড়ে দেন গঙ্গার।
আরো পড়ুন : শিব পুজো যেসব দিয়ে করলে সকল মনস্কামনা পূর্ন হবে
৮। শিবের ১১ তম অবতার হিসেবে আবির্ভাব হনুমানের। রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করতে বিষ্ণু অবতার রামকে সহায়তা করেছিলেন হনুমান। একইসঙ্গে শিব অর্ধ নারীশ্বরের প্রতীক।
৯। শিবকে ডাকা হয় নটরাজ নামে। দুষ্টের দমনে ক্রুদ্ধ শিব নৃত্য শুরু করলে শুরু হয় তান্ডব। এটি নাচের এক ভঙ্গিমা। ধ্বংসের প্রতীকও। শিবের হাতে থাকে ডমরু। এই ভঙ্গী নটরাজ নৃত্য নামেই পরিচিত। শিবের তাণ্ডবে পৃথিবী ধ্বংস হলে ব্রক্ষ্মা আবার নতুন সৃষ্টি করেন। নৃত্যের দেবতা হিসাবে মানা হয় শিবকে।
১০। শিবের হাতে থাকে ত্রিশূল। এর তিনটি ফলা। যা সৃষ্টি, ধ্বংস ও রক্ষার প্রতীক।
১১। শিবের পরনে থাকে বাঘছাল। গঙ্গাধর, কৈলাসপতি, শঙ্কর, মহাকাল-সহ শিবেরও ১০৮ নাম।
১২। অশ্বত্থামা, ভৈরব-সহ শিবের ১৯ টি অবতার। এঁদের মধ্যে বিখ্যাত হনুমান।
আরো পড়ুন : শিবের ৮টি ভুষণের বিশেষ তাৎপর্য
১৩। শিবের আছে তৃতীয় নয়ন। যা কল্পনাশক্তির বাইরে গিয়েও অতিপ্রাকৃত কিছু দেখতে সক্ষম। যোগাভ্যাস ও ধ্যানের প্রভাবে এই তৃতীয় নয়নের অধিকারী হয়েছেন তিনি। এটি শক্তিকে যথাযথ ভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুন : ভারতের সবচেয়ে পবিত্র ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ এর নাম, অবস্থান ও তাদের সৃষ্টির ইতিহাস
১৪। বিষপান করতে কোনও দেবতাই তৈরি ছিলেন না। তখন এগিয়ে এসেন শিব। কন্ঠে ধারণ করেন বিষ। তাই তাঁর গলায় পেঁচানো থাকে সাপ। তাঁর নাম বাসুকি। সাপ বিপদ আর ভয়ের প্রতীক। মর্ত্য মানুষকে ভয় ও বিপদ থেকে রক্ষা করেন তিনি।
১৫। তাঁর মস্তকে বিরাজমান অর্ধচন্দ্র। যা সময়চক্রের প্রতীক। তিনি নেশাতুর। কিন্তু মস্তিষ্ক ধ্যান ও যোগে সক্ষম।
১৬। রাক্ষস রাবন ছিলেন শিবের ভক্ত। তিনি কৈলাসেও গিয়েছিলেন। কিন্তু অধর্মের কারণে শিব তাঁকে দেখা দিতে অস্মমত হন এবং কৈলাস থেকেও চলে যেতেও বলেন। এতে রেগে গিয়ে রাবন কৈলাস পাহাড় উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল।
আরো পড়ুন : শিব পূজায় নিষিদ্ধ যেসব উপকরণ
১৭। বিষ্ণু দুষ্টের দমন করেন যে অস্ত্র দিয়ে সেই চক্র শিবের থেকে পাওয়া। চক্র সূর্যরশ্মির প্রতীক।
১৮। শিবের শরীরের প্রতিটি অলঙ্কার এবং চিহ্নগুলি প্রতীকী করে। ঘাড়ের চারপাশে মুণ্ডমালা, বাঘছাল, ডমরু প্রয়োজনীয় বার্তার প্রতীক। যা জীবনের বুঝতে শেখায়।
১৯। হিন্দুপুরান মতে, শিবের বাসস্থান কৈলাস পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীকে ধারণ করে আছে একটি পদ্ম। কৈলাসের কাছে মানস সরোবর। এটি ইতিবাচক শক্তির প্রতীক। পাশেই রাক্ষস লেক, যা নেতিবাচক শক্তি বোঝায়। এই দুই শক্তিকেই ধারণ করেন শিব।
২০। শিবের আটটি বিশেষ রূপকে একত্রে অষ্টমূর্তি বলে। এঁরা হলেন: ভব (অস্তিত্ব), শর্ভ (ধনুর্ধর), রুদ্র (যিনি দুঃখ ও যন্ত্রণা প্রদান করেন), পশুপতি (পশুপালক), উগ্র (ভয়ংকর), মহান বা মহাদেব (সর্বোচ্চ আত্মা), ভীম (মহাশক্তিধর) ও ঈশান (মহাবিশ্বের দিকপতি)। শিবের পবিত্র সংখ্যা হল পাঁচ। তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রগুলির একটি (নমঃ শিবায়) পাঁচটি অক্ষর দ্বারা গঠিত।
শিবরাত্রির ৫ টি অজানা তথ্য
১. বছরের প্রতি মাসেই আসে শিবরাত্রি। প্রতি কৃষ্ণ পক্ষের ১৪ তম রাত্রি হল শিবরাত্রি। কিন্তু মাঘ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের ১৪ তম রাতে মহাশিবরাত্রি পালন করা হয় কারণ এই রাতটা মহাদেবের সবথেকে পছন্দের।
২. পুরাণ মতে মহাশিবরাত্রির রাত হল বছরের সবথেকে অন্ধকার রাত।
৩. শিবরাত্রির দিনেই পার্বতীকে বিয়ে করেছিলেন মহাদেব। এই রাতেই মিলন হয়েছিল শিব আর শক্তির।
৪. এই দিনে শিব লিঙ্গ রূপ ধারণ করেছিলেন।
৫. শিব রাত্রির তিথি শুরু হওয়ার পর থেকে যে যার সময় মতো সময় করে শিবের মাথায় জল ঢালে। কিন্তু সবথেকে পবিত্র সময় হল ‘নিশিথ কলা’। এই সময়েই শিব লিঙ্গ রূপে
আরো পড়ুন : শিবের সঙ্গে গাঁজা জড়ানো নিছক গাঁজাখুরি
আমাদের প্রতিটি পোস্ট WhatsApp-এ পেতে ⇒ এখানে ক্লিক করুন