“কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া/ আমার ভাইধন রে কইয়ো, নাইওর নিতো বইলা”! এই গানের সুরকার ও গীতিকার যিনি, শেষ বয়সে এসে তিনিও অপেক্ষা করেছিলেন তার আপনজনেদের জন্য। তবে না, তাকে নিতে আসেনি কেউ। শচীন-পত্নী (Sachin Dev Burman), রাহুল দেব বর্মনের (Rahul Dev Burman) মা হওয়া সত্বেও শেষ বয়সে একাকী বৃদ্ধাশ্রমেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মারা যাওয়ার আগে হারিয়েছিলেন মানসিক ভারসাম্য। তিনি শচীন দেব বর্মনের গৃহিনী মীরা দেব বর্মন (Mira Dev Burman)। তবে তার নিজস্ব আলাদা পরিচয়ও ছিল। তিনিও সংগীতজগতের একজন মহাতারকা। তবে নিজেকে কখনও প্রকাশ হতে দেননি।
আজীবন পর্দার আড়ালে থেকে সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মনের গানের কথায় সুর ঢেলে গিয়েছেন মীরা। সংগীতে তার প্রতিভা ছিল অপরিমেয়। জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লা জেলাতে। ছোটবেলায় পারিবারিক অশান্তির কারণেই তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন তার দাদু এবং দিদিমার কাছে। সেখানেই তার সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি। তার দাদু রায়বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস। একসময় তারা কলকাতার সাউথ এন্ডে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানেই শুরু হয় ছোট্ট মীরার পড়াশোনা।
পড়াশোনার পাশাপাশি সংগীতের তালিমও শুরু হয় তার। সংগীতে তার পারদর্শিতার আঁচ পেয়েছিলেন দাদু। তাই নাতনির সংগীত শিক্ষার সঙ্গে আপোষ করেননি কোনও। ছোটতে সঙ্গীতগুরু বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তার শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম শুরু হয়। এরপর সংগীতাচার্য সুরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে কীর্তন এবং ঠুমরি শিক্ষা লাভ করেন তিনি। ১৯৩০ সাল, অনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্র সংগীত শিখতে শুরু করেন মীরা। শুধু সংগীতের ক্ষেত্রেই নয়, নৃত্যচর্চাতেও তার আগ্রহ ছিল। তার জন্য শান্তিনিকেতনে অমিতা সেনের কাছে নৃত্যচর্চা করতে শুরু করেন তিনি। এভাবেই কেটে যায় বেশ কয়েকটা বছর।
কৈশোর পেরিয়ে তখন ধীরে ধীরে যৌবনে পা রাখছেন তিনি। সালটা ১৯৩৭, এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে শচীন দেব বর্মনের তার প্রথম আলাপ হয়। প্রথম দেখাতেই মীরার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যান শচীন। ভালোবাসা গভীর হয়। পরের বছরই চার হাত এক হয়ে যায়। শচীন দেব বর্মন ছিলেন ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ছেলে। বিয়েটা খুব সহজ ছিল না। দুই পক্ষেরই এতে আপত্তি ছিল। তাছাড়া শচীন দেব বর্মন এবং মীরার বয়সের ফারাকটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে দুই পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও শচীন আর মীরার বিয়েটা হয়ে যায়।

১৯৩৯ সালে তাদের পুত্র রাহুল দেব বর্মনের জন্ম হয়। এরপর শচীন দেব বর্মন চলে আসেন বোম্বেতে। সেখানে মীরার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তিনিও সংগীত চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৫ সালে ফের একবার অডিশনে উত্তীর্ণ হয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গজল এবং ঠুমরী পরিবেশন করতেন তিনি। এছাড়াও শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে তিনি বহু গান রেকর্ড করেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে সহকারে সংগীত পরিচালক হিসেবে তার নতুন যাত্রা শুরু হয়। ‘নয়া জামানা’, ‘তেরে মেরে স্বপ্নে’, ‘শর্মিলী’, ‘প্রেমনগর’, ‘অভিমান’ এর মতো বিখ্যাত সিনেমার সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। নিজেকে প্রচারের আড়ালে রেখেই স্বামী এবং পুত্রকে সংগীতজগতের উৎকর্ষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন মীরা দেব বর্মন।
তবে শেষ বয়সে মর্মান্তিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে তাকে। স্বামী এবং একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর তার আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে বৃদ্ধাশ্রম। শেষ বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। কাছের মানুষদের হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়েছিলেন। সেই সময় শুধু শচীন দেব বর্মনের গান শুনলেই তারমধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিত। রাহুল দেব বর্মনের স্ত্রী আশা ভোঁসলে স্বামীর মৃত্যুর পর শাশুড়ি-মাকে রেখে আসেন ফাসির বৃদ্ধাশ্রমে। ২০০৭ সালে সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।