গৃহিণী থেকে মহানায়িকা, সুচিত্রা সেনের জীবন কাহিনী

৬০-৭০ দশকের টলিউড (Tollywood), নায়িকা (Actress) বলতে তখন সকলে এক বাক্যে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকেই (Suchitra Sen) বুঝতেন। অসাধারণ সুন্দরী এবং আপাদমস্তক আভিজাত্যের মোড়কে মোড়া এই বঙ্গকন্যার কাছে নায়িকা হওয়ার সব উপাদানই মজুত ছিল। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও উত্তম-সুচিত্রার জুটি টলিউডে আজও হিট। উত্তম-সুচিত্রার জুটির মতো জনপ্রিয়তা আজ পর্যন্ত টলিউড তো দূরের কথা, বলিউডেও নজিরবিহীন।

তৎকালীন সময়ে সিনেমা জগতে বহুল প্রচলিত একটি ধারণা ছিল যে বিয়ের পর মহিলারা আর নায়িকা হয়ে উঠতে পারেন না। তবে এই ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে ভুল প্রমাণিত করেছিলেন মিসেস রমা সেন। তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেন। রমা থেকে সুচিত্রা হয়ে ওঠার লড়াইয়ের পথে বহু কটাক্ষ, বহু বাধা, অপমান সইতে হয়েছে তাকে। তবে সেসব উপেক্ষা করে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন রমা, ওরফে সুচিত্রা।

কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনি রমা সেন বিয়ের পর স্বামীর হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়েছিলেন ইন্টারভিউ দিতে। রমার কথায় বাংলাদেশি টান শুনেই তাকে প্রত্যাখান করে দিয়েছিলেন বিশিষ্ট এক পরিচালক। শুধু তাই নয়, তিনি হলফ করে বলেছিলেন, “দেখব রমা কিভাবে হিরোইন হয়! যদি হয়তো আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে।” তখনকার মতো মুখে কিছু না বললেও পরবর্তী দিনে মহানায়িকা কিন্তু সেই পরিচালককে উপযুক্ত জবাবই দিয়েছিলেন।

সুচিত্রা মহানায়িকা হয়ে ওঠার পর তার কাছে কাজের প্রস্তাব নিয়ে পরিচালকেরা নিজে ছুটে আসতেন। সুচিত্রাকে যিনি অপমান করেছিলেন, সেই পরিচালকের সম্মুখীন হয়ে মহানায়িকা তাকে বলেছিলেন, “দেখি আপনার হাতটি কোথায়? হাতের তালুতে চুল গজানোর কথা ছিল তো! আমিতো হিরোইন হয়ে গেছি।” সুচিত্রার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫১ সালে, পরিচালক সুকুমার রায়ের হাত ধরে। ‘সাত নম্বর কয়েদী’, তার অভিনীত প্রথম ছবি। প্রথম ছবিতে অভিনয়ের পরেই বাংলাদেশের বাড়ি ছেড়ে স্বামীকে নিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন অভিনেত্রী।

‘শেষ কোথায়’ ছবির হাত ধরে টলিউডে নায়িকা হিসেবে তার পথ চলা শুরু হয়। যদিও সেই ছবিটি পর্দায় মুক্তি পায়নি। এরপরে ১৯৫৩ সালে টলিউডের পর্দায় ঘটে গেলো মিরাকেল। উত্তম কুমারের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয় করে ফেললেন সুচিত্রা। তাদের এই জুটি টলিউডের পর্দায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলো। উল্লেখ্য, অভিনয় জগতে পা রাখার পরেই রমা নিজের নাম বদলে ফেলেছিলেন।

‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার কেমিস্ট্রি এতটাই জমে উঠেছিল যে দর্শকের মনেও তা ভীষণভাবে গেঁথে গিয়েছিলো। এরপর থেকে সেই ম্যাজিক ধরা পড়তে শুরু করে টলিউডের একের পর এক ছবিতে। ওই বছরই উত্তম কুমারের সঙ্গে ৯টি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছিলেন সুচিত্রা। নায়িকা হয়ে উঠলেন মহানায়িকা। তবে শুধু অভিনেত্রী হিসেবেই নয়, তৎকালীন সময়ে টলিউড নায়িকাদের মধ্যে ফ্যাশন স্টেটমেন্টের নিরিখেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্যা।

বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতো তার ছবি। একাধারে শাড়িতে যেমন আদ্যোপান্ত সাবেকিয়ানা তুলে ধরতেন ক্যামেরার পর্দার সামনে, তেমনই আবার ইন্দো-ওয়েস্টার্ন পোশাকে, চোখে রোদ চশমা ও মাথায় টুপি দিয়েও পেজ ৩ এর পাতা আলোকিত করে তুলেছিলেন তিনি। তবে কেরিয়ারের শীর্ষে থাকাকালীন সময়েই তিনি একদিন আচমকা টলিউড থেকে গায়েব হয়ে যান। শুটিং ফ্লোর থেকে অবসর নিয়ে একদিনের জন্যও আর প্রকাশ্যে আসেননি সুচিত্রা।

তার এমন সিদ্ধান্ত তার অনুরাগীদের ব্যথিত করে তুলেছিল। একদিকে উত্তম কুমারের আচমকা মৃত্যু, অপরদিকে মহানায়িকার চিরতরে ক্যামেরার আড়ালে চলে যাওয়াটা বাঙালির হৃদয় ভেঙে দিয়েছিল। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল তাকে। এই পুরস্কার নেওয়ার জন্য ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। এই শর্ত শুনেই বেঁকে বসেন মহানায়িকা। তিনি যে কখনও জনসমক্ষে আসবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলেন! সেই প্রতিজ্ঞার মান রাখতে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের মত সম্মানও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মহানায়িকা।