বাংলা সিনে (Bengali Cinema) দুনিয়ার কিংবদন্তি অভিনেতা ছিলেন জহর রায় (Jahar Roy)। স্বর্ণযুগের শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। একসময় থিয়েটার থেকে টলিউড (Tollywood) দাপিয়ে বেরিয়েছিলেন তিনি। বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন জহর রায়। কিন্তু একটা সময়ের পর তার জীবনে নেমে আসে চরম অন্ধকার। ওই সময় তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল টলিউডও। তারপরে তার যে পরিণতি হয়েছিল তা কল্পনাও করতে পারবেন না কেউ।
জহর রায়ের জন্ম হয়েছিল ১৯১৯ সালে, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে। এখন তার জন্মস্থান চলে গিয়েছে বাংলাদেশের আওতায়। তার পিতার সতু রায় ছিলেন নির্বাক যুগের একজন প্রখ্যাত অভিনেতা। তাই জহর রায়ের প্রতিভা ছিল জন্মগত। একটু ভাল রোজগারের আশায় জহর রায়ের বাবা স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। এরপর কলকাতাতেই বেড়ে ওঠেন জহর রায় এবং তার ভাই-বোনেরা।
সংসারে প্রবল আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনা বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি জহর। তবে তিনি ছোট থেকেই বড় অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাই অভিনয়টাকেই ভাল করে শিখতে শুরু করেন। তার কেরিয়ার শুরু হয়েছিল অ্যামিচার থিয়েটার থেকে। তিনি ছিলেন চার্লি চ্যাপলিনের অনেক বড় ভক্ত। তবে আর্থিক অনটনের কারণে আলাদা পেশাও নিতে হয়েছিল তাকে।
সংসার চালাতে একসময় দর্জির দোকান খুলে বসেছিলেন জহর রায়। তবে অভিনয় করার তীব্র বাসনা ছিল তার মনে। তাই সব কিছু ছেড়ে টলিউডে গিয়ে কাজ খুঁজতে শুরু করে দেন তিনি। প্রথম প্রথম ছোটখাটো কিছু চরিত্ররা পেতেন। তবে বিমল রায়ের ‘অঞ্জনগড়’ ছবিটি টলিউডের মাটিতে তার শক্ত জায়গা গড়ে দেয়। এরপর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার জুটিও দর্শকদের মনে ধরে।
ভানুর সঙ্গে ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ করে তখন তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। সেই সঙ্গে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘পরশপাথর’, ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ ইত্যাদি বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করে তিনি শিল্পীর মর্যাদা পান। তবে তিনি কখনও তার কাজের মর্যাদা পেলেন না। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনেও পেলেন না সুখ। কেরিয়ারে বেশ ভালই এগোচ্ছিলেন, তবে মেয়ের মৃত্যুতে সবকিছু কেমন যেন থমকে গেল।
প্রথম কন্যা সন্তান জন্মের কিছুদিন পরেই মৃত্যু হয়। এই শোক তিনি মেনে নিতে পারেননি। দুঃখ ভুলে থাকতে মদ্যপান করতে শুরু করেন। পরে একে একে তার চার সন্তানের জন্ম হয়। তবে প্রথম সন্তানকে হারানোর শোক তিনি সামাল দিতে পারেননি। এরপর তার শরীর ভেঙে যায়। তখন আর তেমন কাজও পেতেন না তিনি। চরম অর্থাভাব ঘিরে ধরে তাকে। এমনকি তার বন্ধুরাও তাকে এড়িয়ে যেতেন এই ভয়ে যে তিনি হয়তো টাকা ধার চেয়ে বসবেন!
এভাবে বেশি দিন জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে পারেননি তিনি। ১৯৭৭ সালে মেডিকেল কলেজে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার পাশে ছিলেন কেবল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া আর কেউ তার খোঁজ নিতে আসেননি। বন্ধু সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরে একবার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন, ‘‘এই দেশের কাছে কি সত্যিই জহর রায়ের কিছু পাওনা ছিল না? তিনি অন্য দেশে জন্মালে তো স্যার উপাধি পেতেন।”