প্রয়াত হলেন বাংলা সিনেমা জগতের প্রখ্যাত শিল্পী মনোজ মিত্র (Manoj Mitra)। থিয়েটার তথা টলিউডের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ছিলেন তিনি। অথচ তার শেষ জীবনের পরিণতি ছিল খুবই করুণ। বৃদ্ধ বয়সে চরম হেনস্থা করে বাড়িছাড়া করা হয় তাকে। ৮০ বছর বয়সে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয় মনোজ মিত্রকে।
মনোজ মিত্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৩৮ সালের বাংলাদেশের খুলনায়। শুধু একজন অভিনেতা নন, মনোজ মিত্র অধ্যাপক, নাট্য রচয়িতা এবং নাটকের নির্দেশকও ছিলেন। ছোটবেলায় গ্রামের বিভিন্ন পালা-পার্বণে নাটক দেখে দেখে অভিনয়ের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। ছোট থেকেই তিনি স্কুলের বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করতেন। তারপর তারা চলে আসেন কলকাতায় এবং এখান থেকেই স্কুল এবং কলেজের পড়াশোনা করেন মনোজ মিত্র। ১৯৬০ সালে দর্শনে এমএ পাস করেন মনোজ মিত্র। তখন থেকেই শুরু হয় লেখালেখি। বিভিন্ন পত্র এবং পত্রিকার জন্য তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন।
তবে থিয়েটার, নাটক, অভিনয় ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ বরাবরই ছিল মনোজ মিত্রের। তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলে সুন্দরম নামের একটি থিয়েটার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আবার অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার মধ্যে। রানীগঞ্জের ত্রিবেনী দেবী ভালোটিয়া কলেজে অধ্যাপনা করার পাশাপাশি তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাও করতেন।
কিন্তু একটা সময় পর নাটকের প্রতি তার আগ্রহ এত বেড়ে যায় যে তিনি অধ্যাপনা এবং গবেষণা দুটোই বন্ধ করে দেন। পাকাপাকিভাবে চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতাতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন মনোজ মিত্র। কলকাতায় এসে তিনি একটি কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব নেন আবার। সেই সঙ্গে নতুন একটি নাট্যদল গড়ে তোলেন। এই নাটকের দলের জন্য গল্প তিনি লিখতেন। পরিচালনাও করতেন, আবার অভিনয়ও করতেন।
মনোজ মিত্রের অভিনীত প্রথম বাংলা সিনেমা ছিল বাঞ্ছারামের বাগান। তারপর থেকে সিনেমা এবং থিয়েটার উভয়দিকেই তিনি সমানভাবে কাজ করতে শুরু করেন। মনোজ মিত্র বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত, তপন সিনহা, তরুন মজুমদার, গৌতম ঘোষের মত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। থিয়েটারের প্রতি তার অবদানের জন্য তাকে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
মনোজ মিত্র অভিনয়ের প্রতি অবদানের জন্য গিরিশচন্দ্র পুরস্কার, সংগীত নাটক একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাটকের বেশ কয়েকটি বইও লিখেছিলেন। একটা সময় পর্যন্ত টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে চুটিয়ে কাজ করেছিলেন মনোজ মিত্র। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের কাজ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ জীবন পর্যন্ত লেখালেখি জারি রেখেছিলেন অভিনেতা।
শেষ বয়সে চরম এক হেনস্থার মুখে পড়তে হয় মনোজ মিত্রকে। কলকাতায় আসার পর তিনি যে বাড়িতে দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর ধরে ভাড়া ছিলেন, সেই বাড়ি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয় জিনিসপত্র সমেত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নাকি বাড়ি ভাড়া দিতেন না। আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল এই মামলা। আদালতের নির্দেশে তাকে সেই বাড়ি ছাড়তে হয়। ওই বাড়িতে নিয়মিত নাটকের মহড়াও চালাতেন মনোজ মিত্র। নাটকের সেইসব জিনিসপত্রও রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে যায়। এতে মনে মনে খুবই আঘাত পেয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন : বাঙালি হয়েও রবীন্দ্রনাথের অপমানে হেসে গড়ালেন কাজল! ছিঃ ছিঃ করছে গোটা দেশ
আরও পড়ুন : কোথায় হারিয়ে গেলেন অমৃতা রাও? এখন কেমন দেখতে হয়েছে তাকে?
দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্য জনিত অসুখে ভুগছিলেন মনোজ মিত্র। এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সল্টলেকের ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন তিনি। বুকে ব্যথায় এবং শ্বাসকষ্ট ছিল। শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মাত্রা নেমে গিয়ে রক্তচাপ খুবই কমে গিয়েছিল তার। এরপর বাড়ি ফিরলেও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি তিনি। এই বছর একাধিকবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বছরের শুরুতেই তার বুকে পেসমেকার বসেছিল। শেষমেষ ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি এই শিল্পী।