সময়টা তখন ৬০-৭০ এর দশক। কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে (Satyajit Roy) তখনও চিনে ওঠেনি বাংলা। তবে সত্যজিৎ রায় তখন থেকেই কার্যত টলিউডের ভোল পাল্টে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। বাংলা সিনেমা জগতে তখন যেমন ধরনের ছবি প্রচলন ছিল তাকে টপকে গিয়ে তিনি এক অনবদ্য সিনেমা উপহার দিতে চাইছিলেন টলিউডকে। সিনেমার নাম ‘পথের পাঁচালী’। এই সিনেমার শিশু অভিনেতা সুবীর ব্যানার্জীই (Subir Banerjee) বাঙালির ‘অপু’।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাসকে সত্যজিৎ রায় যে চোখে কল্পনা করেছিলেন তাকে ক্যামেরায় ফুটিয়ে তোলা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তখন তার হাতে টাকা ছিল খুবই কম। অত সামান্য টাকায় আনকোরা নতুন মুখদের নিয়ে সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’র মত সিনেমা উপহার দেন গোটা বিশ্বকে। উপন্যাসের দুই চরিত্র অপু-দুর্গা আজও বাঙালির নস্টালজিয়া। সত্যজিতের এই ছবিতেই অপু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুবীর ব্যানার্জী।
বিভূতিভূষণের গল্পকে পর্দার সামনে উপস্থাপন করতে সত্যজিৎ রায়ের প্রয়োজন ছিল ৫-৭ বছর বয়সী ছোট্ট একটি ছেলের। কিন্তু সেই ছেলেটিকে তিনি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শিশু অভিনেতার খোঁজে তিনি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যজিৎকে অপুর সন্ধান এনে দিয়েছিলেন তার স্ত্রী বিজয়া। যে ছেলেটিকে তারা গোটা কলকাতা শহরজুড়ে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন, সে আসলে ঠিক তাদের পাড়াতে এই কয়েকটা বাড়ির পাশেই থাকত।
একদিন বাড়ির পাশেই ছোট্ট সুবীরকে খেলতে দেখে বিজয়া তার কথা সত্যজিৎকে বলেন। তাকে তৎক্ষণাৎ বাড়িতে ডেকে আনা হয়। তাকে কিছু প্রশ্ন করার পরই সত্যজিৎ মনে মনে ঠিক করে নেন এই ছেলেটিই হবে তার ‘পথের পাঁচালী’র অপু। সুবীর ব্যানার্জী কখনও প্রফেশনাল অভিনেতা ছিলেন না। বিশেষত তার বাবাও চাননি ছেলে অতটুকু বয়সে অভিনয় করুক। কিন্তু সত্যজিৎ রায় তাকে মানিয়ে নেন।
সত্যজিৎ রায় সুবীর ব্যানার্জীর বাবাকে সেদিন বলেছিলেন, “আজকে হয়তো আমাকে আর আপনার ছেলেকে কেউ চেনে না। কিন্তু আমি এমন একটি ছবি বানাতে চলেছি যা গোটা বাংলা সিনেমাকে পরিবর্তন করে দেবে। তখন সবাই আমাদের চিনবে।” সত্যজিৎ রায় তার কথা রেখেছিলেন। তিনি যে কালজয়ী সিনেমা উপহার দিয়ে গিয়েছেন বাঙালিকে, অপ-দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করে সুবীর ব্যানার্জি এবং উমা দাশগুপ্ত ছিলেন সেই ছবির নায়ক-নায়িকা। তাই দর্শকদের কাছে আজও অতি পছন্দের পাত্র তারা।
সুবীরবাবু এই ছবিতে কোনও অভিনয় অভিজ্ঞতা ছাড়াই একদম স্বাভাবিক অভিনয় করেন। তবে এই ছবির উপর আর কখনও তাকে অভিনয় করতে দেখা যায়নি। বড় ভয়ে তিনি কলকাতার শহরতলীতে একটি কারখানাতে চাকরি করতেন। কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম অবশ্য দাবী করে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কেরানী ছিলেন। কয়েক বছর আগে ইটিভি বাংলার একটি অনুষ্ঠান তাকে শেষবার পর্দার সামনে দেখা যায়। ‘পথের পাঁচালী’র ছোট্ট অপু বর্তমানে ৭৯ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ। তার সম্পর্কে তেমন বড় একটা খবর মেলে না সংবাদ মাধ্যমগুলোতে।