কোন রোগ বাসা বেঁধেছে অস্মিকার শরীরে? তার চিকিৎসার ইনজেকশন কেন এত দামী?

বিগত বেশ কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল ছোট্ট মেয়ে অস্মিকা দাস। বয়স সবে মাত্র এক বছর। অথচ কি ভীষণ এক কঠিন রোগের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটি। তাকে এই রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারে ১৬ কোটি টাকার একটি ইনজেকশন। তাই সমাজ মাধ্যমে সাহায্য চেয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অস্মিকার বাবা ও মা। অস্মিকার কথা শুনেই কার্যত চমকে উঠেছেন নেট নাগরিকরা। ছোট্ট অস্মিকার শরীরে বাসা বেঁধেছে কোন ভয়ংকর রোগ? কেনই বা তার চিকিৎসার ইনজেকশনের দাম ১৬ কোটি টাকা?

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রফি টাইপ ১ রোগে আক্রান্ত অস্মিকা। তাকে বাঁচাতে গেলে প্রয়োজন জিন থেরাপি। লাগবে অরফ্যান ড্রাগ। তবে ভারতের কোথাও এই রোগের ওষুধ তৈরি হয় না। ওষুধটি তৈরি করে কেবল আমেরিকা বা ইউরোপিয়ান দেশগুলো। সেখানে শুধু ওষুধের দামই ৯ কোটি টাকা। ট্রান্সপোর্টেশন এবং ট্যাক্স মিলিয়ে ওই ওষুধ ভারতে আনতে খরচ হবে মোট ১৬ কোটি টাকা। আর ৬ মাসের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করা গেলে ধীরে ধীরে অস্মিকার গোটা শরীর অবশ হয়ে যাবে। অথচ ক্রাউড ফান্ড থেকে উঠেছে মাত্র ৫ কোটি টাকা। এখনও প্রয়োজন ১১ কোটি টাকা। আগামী ৬ মাসের মধ্যে ইনজেকশন না দেওয়া গেলে অস্মিকার পরিণতি হবে ভয়ংকর।

Asmika Das

চিকিৎসকদের মতে, স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোপি রোগটি সার্ভাইভাল মোটর নিউরন প্রোটিনের অভাব থেকে হয়। যার শরীরে এই প্রোটিনের অভাব যত বেশি তাদের ক্ষেত্রে সেই রোগের ভয়াবহতা তত বেশি হয়। এটি একটি নিউরো মাস্কুলার ডিসঅর্ডার বা স্নায়ু পেশির রোগ। তবে এই রোগ মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে না। বরং এ রোগে আক্রান্তদের বুদ্ধি সাধারণের থেকে বেশিই হয়। এই রোগ থাবা বসায় মানুষের শিরদাঁড়ায়। যার ফলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম অকেজো হয়ে যায়। নিশ্বাস নেওয়া, খাবার খাওয়া, চোখের পাতা নাড়ানো, এইসব কাজ করতে পারে না রোগী।

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি প্রধানত চার ধরনের হয়। SMA Type 1, SMA Type 2, SMA Type 3 ও SMA Type 4। এর মধ্যে সব থেকে ভয়ংকর এবং কষ্টদায়ক SMA Type 1, যে রোগে আক্রান্ত হয়েছে অস্মিকা।

SMA TYPE 1

SMA Type 1 : এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের জন্মের ৬ মাসের মধ্যেই উপসর্গ ধরা পড়ে। SMA Type 1 – এ আক্রান্তদের বসার ক্ষমতাটুকুও থাকে না। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে সেই রোগীকে বাঁচানোই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দুর্ভাগ্যবশত অস্মিকার রোগটি এই ক্যাটাগরিতেই পড়ে।

SMA Type 2 : যারা এই টাইপে আক্রান্ত তারা উঠে বসতে পারলেও হাঁটাচলা করতে পারেন না।

SMA Type 3 : এই তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের অবস্থা বাকিদের তুলনায় ভালো। তারা উঠে বসতে, চলাফেরা করতে পারেন। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে একা একা উঠানামা করতে পারেন না। পড়ে যান এবং হোঁচট খাওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয়।

SMA Type 4 : এই চতুর্থ টাইপে যারা আক্রান্ত হন তাদের অসুখ ছেলেবেলাতে ধরা পড়ে না। ৩০ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎই হাত-পা নাড়াচাড়া করতে অসুবিধা দেখা দেয় এদের ক্ষেত্রে। পেশি বা মাসলের যেকোনও কাজেই সমস্যা দেখা দেয়।

Asmika Das

কেন হয় এমন ভয়ঙ্কর রোগ?

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রফি জিন ঘটিত রোগ। যদি বাবা ও মা দুজনে্য শরীরে এই রোগের উপস্থিতি থাকে সেক্ষেত্রে তাদের সন্তান এই রোগে আক্রান্ত হন। দুটি অ্যাবনর্মাল ডিএনএর মিলনে যে সন্তানের জন্ম হয় তার ডিএনএতে এই রোগের লক্ষণ থাকে। যদিও এক্ষেত্রে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ১/৪ ভাগ। এটি একটি অটোজোমাল রিসেসিভ ডিসঅর্ডার। এক্ষেত্রে বাবা ও মা দুজনের শরীরেই এই রোগটি থাকে। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ থাকে না। সারা জীবনে তারা জানতেও পারেন না যে এই রোগ তাদের রয়েছে। তাদের সন্তানের মধ্যে এই রোগ থাকার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ।

আরও পড়ুন : ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ রে ননি ছিঃ’ গানটি বাংলায় হলে কেমন হত? শুনে নিন বাংলা ভার্সন

স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রফি রোগের চিকিৎসা কী?

সাধারণত এত জটিল রোগের চিকিৎসা ভারতে নেই। বিদেশে অবশ্য উন্নত মানের চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে শিশুর মায়ের গর্ভে থাকাকালীনই টিস্যু পরীক্ষা করিয়ে রোগ ধরা যায়। চাইলে দম্পতিরা গর্ভপাত করাতে পারেন। নয়তো সন্তানের জন্মের পর জিন থেরাপি করতে হবে। ভারতে জন্মের আগে এরকম স্ক্রিনিংয়ের কোনও সুযোগ নেই বাবা-মায়েদের জন্য। আবার জিন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা সমস্যা।

প্রধানত তিনভাবে এই রোগের চিকিৎসা করা যায়।

প্রথমটি ওষুধের মাধ্যমে। স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রফি রোগের ওষুধ রিসডি প্লাম ভারতে পাওয়া যায়। তবে তার একটি শিশির দামই ৬ লক্ষ টাকা। যতদিন বাঁচবেন ততদিন রোগীকে এই ওষুধ খেয়েই যেতে হবে। এতে রোগ পুরোপুরি নিরাময় হবে না। ওষুধের মাধ্যমে টাইপ ওয়ান কে কেবল টাইপ টু তে রূপান্তর করা যাবে।

দ্বিতীয়টি হল ইনজেকশনের মাধ্যমে। এ রোগের প্রতিকারের বিশেষ একটি ইনজেকশনের নাম নুসানার্সেন। বছরে তিনবার এই ইনজেকশনটি দিতে হবে। যার দাম ১ লক্ষ টাকা। প্রত্যেকবার শিরদাঁড়াতে ইনজেকশনটি দিতে হবে। এতেও রোগীকে টাইপ ওয়ান থেকে টাইপ টু তে রুপান্তর করে বাঁচিয়ে রাখা যায়।

আরও পড়ুন : ইঞ্জেকশনের দাম ১৬ কোটি টাকা! হাতে আর মাত্র ৭ মাস, বিরল রোগে আক্রান্ত এই শিশুটিকে বাঁচান

তৃতীয়টি হল জিন থেরাপি। এই চিকিৎসায় শরীরের ভেতর ইনজেকশনের মাধ্যমে বিশেষ ধরনের অ্যাডিনো ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়। যে ওষুধের নাম অনাসমোনোজিনি অ্যাবিপারভোভেক। ভাইরাস শরীরে ঢুকে কোশে কোশে বংশবিস্তার করে সারভাইভাল মোটর নিউরন প্রোটিন তৈরি করে। জিন থেরাপির শর্ত একটাই, বয়স ২ বছর হওয়ার মধ্যেই শিশুটিকে ইনজেকশন দিতে হবে।

গোটা পৃথিবীতে ৫ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে এই রোগে আক্রান্তদের বুদ্ধি এবং মেধা খুব বেশি থাকে। কারণ এদের শরীর অবশ হলেও ব্রেন খুবই সচল থাকে। তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার বুদ্ধি থাকে তাদের। এই রোগীদের মধ্যে অনেককেই দেখা যায় সহজেই আইআইটি কিংবা নিট পরীক্ষার মত জটিল পরীক্ষা পাশ করে ফেলছেন কিংবা বায়োটেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করছেন। এই রোগ যেহেতু ব্রেনের উপর প্রভাব ফেলে না তাই এই ধরনের শিশুরা খুবই ইন্টেলিজেন্ট হন। কিন্তু ধীরে ধীরে এদের হাতে ও পায়ের পেশি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অনেকটা ঠিক বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মত। যিনি এত বড় মাপের বিজ্ঞানী হওয়া সত্বেও তার সম্পূর্ণ জীবন হুইল চেয়ারেই কেটেছিল। আপাতত অস্মিকাকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ইনজেকশনের জন্য ৫ কোটি টাকার জোগাড় হয়েছে ক্রাউড ফান্ডে, প্রয়োজন এখনও আরও ১১ কোটি টাকা। এই ইনজেকশনের উপরেই নির্ভর করছে ছোট্ট মেয়েটির ভবিষ্যৎ।