যৌনকর্মী থেকে অভিনেত্রী, নটি বিনোদিনীর করুণ জীবন কাহিনী

বিনোদিনী দাসী (Binodini Dasi), ওরফে নটি বিনোদিনীর নাম শোনেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। এই বছরই দেবের প্রযোজনা সংস্থা রিলিজ করবে বিনোদিনীর জীবন কাহিনীর উপর সিনেমা, ‘নটি বিনোদিনী, এক নটির জীবনের উপাখ্যান’। নাম ভূমিকায় থাকছেন রুক্মিণী মৈত্র। আবার অতি সম্প্রতি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার স্টার থিয়েটারের নাম বদলে রাখলেন বিনোদিনী থিয়েটার। কিন্তু প্রশ্ন হল কে এই বিনোদিনী? ২০০ বছর পরেও কেন তাকে নিয়ে এত চর্চা? এত মাতামাতি হয় এখনও?

বিনোদিনী কে? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে ২০০ বছর। ১৮৬৩ সালে কলকাতার একটি যৌনপল্লীতে জন্ম হয় বিনোদিনী দাসীর। সেখানেই তিনি গঙ্গা বাইয়ের কাছে সংগীতের তালিম নেন। হয়তো বা আর পাঁচজন যৌনকর্মীর মতই হত তার জীবন। কিন্তু তার ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল। শুধু যৌনকর্মী হওয়ার জন্য জন্মাননি বিনোদিনী। ব্রিটিশ শাসন কালে বাংলার থিয়েটার সমাজে যেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরুষেরা, মহিলাদের প্রবেশ যেখানে ছিল নিষিদ্ধ, পুরুষেরাই মহিলাদের চরিত্র করতেন, বিনোদিনী একটি মেয়ে হয়েও সেই অভিনয় দুনিয়াতে পা রাখার সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবনের প্রতি পদে পদে ছিল চরম দুঃখ, যন্ত্রণা ও বিশ্বাসঘাতকতা।

Binodini Dasi

বিনোদিনীর অভিনয় জীবন শুরু হয় মাত্র ১২ বছর বয়সে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান বিনোদিনী। কিন্তু তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সে অভিনয় ছেড়েও দেন। এর নেপথ্যের কাহিনী ছিল খুবই করুণ। বিনোদিনীর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’র প্রতি ছত্রে ছত্রে লেখা আছে সেই যন্ত্রণার কথা।

আসলে বিনোদিনীর জীবনটা ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। ছোটবেলাতেই তার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু আজীবন তিনি তার স্বামীর মুখ দেখতে পাননি। পরে এক বাড়িওয়ালা তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তিনিও বিনোদিনীকে ঠকিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে নেন। এরপর তৎকালীন সময়ের বড় ব্যবসায়ী গুরমুখ রায় আসেন বিনোদিনীর জীবনে। এরপর নতুন মোড় নেয় বিনোদিনীর জীবন। তখন থিয়েটার জগতে বিনোদিনী ছিলেন অনেক বড় নাম। খোদ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ‘চৈতন্য প্রভু’ নাটকে শ্রীচৈতন্যের চরিত্রে তার অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। বিনোদিনী তখন নিজের নামে নতুন থিয়েটার গড়ার দু চোখ ভরা স্বপ্ন দেখছেন। ঠিক সেই সময়েই গুরমুখ তার জীবনে নিয়ে এসেছিলেন প্রেমের নতুন জোয়ার।

Binodini Dasi

গুরমুখ বিনোদিনীকে নতুন থিয়েটার গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ৫০,০০০ টাকাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার শর্ত ছিল, বিনোদিনীকে আজীবন তার দাসী হয়েই থাকতে হবে। বিনোদিনী সেই প্রস্তাবে রাজি হন। গুরমুখের টাকায় তিনি এবং তার সহকর্মীর থিয়েটার শিল্পীরা মিলে কলকাতার ওয়াইডন স্ট্রিটে গড়ে তোলেন নতুন থিয়েটার। কিন্তু বিনোদিনীরও শর্ত ছিল একটি। তিনি চেয়েছিলেন থিয়েটারের নাম যেন তার নামে হয়। কিন্তু তার সব স্বপ্ন ভেঙে যায় যখন থিয়েটার গড়ে ওঠে।

আরও পড়ুন : মদের দোকানের সামনে করতেন কাজ! দুটো টাকা রোজগার করতে দিনরাত স্ট্রাগল করেছেন কাঞ্চন মল্লিক

বিনোদিনী দেখেন নতুন থিয়েটারের নাম তার নামে হয়নি। নতুন সেই থিয়েটারের নাম দেওয়া হয় স্টার থিয়েটার। এতে ভেঙে খানখান হয়ে যায় বিনোদিনীর মন। এই বিশ্বাসঘাতকতাতেই বিনোদিনী মাত্র ২৩ বছর বয়সে থিয়েটার ছেড়ে দেন। বিনোদিনী থিয়েটার ছেড়ে দিলে গুরমুখও তার সাধের নির্মিত স্টার থিয়েটার বিক্রি করে দেন। পরে যখন কলকাতা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের রাস্তা বাড়ানোর কাজ চলছিল তখন স্টার থিয়েটার ভেঙে ফেলা হয়। অন্য জায়গায় নতুন স্টার থিয়েটার নির্মাণ করা হয়।

আরও পড়ুন : প্রজাপতিকে টপকে গেল খাদান! নিজেই নিজের রেকর্ড ভাঙলেন সুপারস্টার দেব

বিনোদিনী তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন কিভাবে জীবনে প্রতি পদে পদে তাকে অসম্মানিত ও প্রতারিত হতে হয়েছে। এমনকি তার প্রেমিকও কথা রাখেননি। ঠকিয়েছিলেন তাকে। জীবদ্দশায় নিজের নামে থিয়েটার দেখে যেতে পারেননি বিনোদিনী। ১৯৪১ সালে তার মৃত্যু হয়। প্রায়ই ১৫০ বছর পর বিনোদিনীর সেই অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ করল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। স্টার থিয়েটারের নতুন নাম হল বিনোদিনী থিয়েটার।