আত্মহত্যা নাকি খুন? মহুয়া রায়চৌধুরীর (Mahua Roy Choudhury) মৃত্যুর রাতে ঠিক কী ঘটেছিল? কেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে মর্মান্তিক পরিণতি হল টলিউডের (Tollywood) এই তারকার? তার মৃত্যুর পেছনে কি ছিল কোনও ষড়যন্ত্র? নাকি নিছক দুর্ঘটনা বলে আসল সত্যিটাকে কোনদিনও জানতেই দেওয়া হল না কাউকে। মহুয়া রায় চৌধুরীর জীবনের এই কাহিনী শুনলে আপনার চোখেও জল আসবে।
সুচিত্রা সেনের মত গ্ল্যামার হয়তো ছিল না তার, কিন্তু অভিনয় দক্ষতার জন্য তাকে সুচিত্রা পরবর্তী সময়ে মহানায়িকার যোগ্য উত্তরসূরী বলা হত। খুব ছোট বয়সে অভিনয়ে পা রেখেছিলেন তিনি। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল নাচ দিয়ে। মহুয়ার আসল নাম ছিল শিপ্রা রায়। তার বাবা নীলাঞ্জন ছিলেন খুবই লোভী প্রকৃতির মানুষ। শিপ্রার মধ্যে নাচ এবং অভিনয়ের প্রতিভা আছে দেখে তিনি তাকে ছোট থেকেই টাকা ছাপানোর মেশিনের মত ব্যবহার করতে শুরু করেন।
আসলে নীলাঞ্জন রায়ে নিজেরও অভিনয়ে আসার ইচ্ছে ছিল। মুম্বাইতে বেশ কয়েক বছর চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। মেয়ের মধ্যে প্রতিভা আছে দেখে তিনি সেই প্রতিভাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানোর ত্রুটি রাখলেন না। বলা হয় তিনি নাকি মহুয়ার আসল বাবাও নন। মহুয়ার জন্ম পরিচয় নিয়েও রয়েছে অনেক জল্পনা। তবে সে যাই হোক, ছোট থেকেই স্টেজে নাচতেন মহুয়া। একবার উত্তর কলকাতার একটি নাচের আসরে সুচিত্রা সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রের মত শিল্পীদের সামনে নাচের সুযোগ পান মহুয়া। তখন তার বয়স মাত্র ৭ বছর। নাচ দেখিয়ে টলিউডের তৎকালীন তারকাদের মুগ্ধ করেছিল ছোট্ট শিপ্রা।
শিপ্রা ততদিনে কলকাতা এবং তার আশেপাশের এলাকা নেচে মাতিয়ে রেখেছে। তখন তার নতুন নাম হয় সোনালী রায়। মেয়ের এই নাচের অনুষ্ঠান থেকে যা কিছু আয় হত তা মদের আসরে দেদার খরচ করতেন নীলাঞ্জন রায়। ছোট থেকেই পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন মহুয়া ওরফে সোনালী। কিন্তু তাকে পড়াশোনা ছাড়িয়ে গ্ল্যামার দুনিয়াতে ঠেলে দেন নীলাঞ্জনবাবু। সুখেন দাসের ‘নয়া মিছিল’ সিনেমায় একটি নতুন মুখের প্রয়োজন ছিল।
সুখেন দাস সোনালীকে তার ছবির জন্য বেছে নেন। কিন্তু পরিচালকের আবার এত রোগা-পাতলা মেয়েকে নায়িকা হিসেবে একেবারেই পছন্দ হয়নি। হতাশ হয়েই ফিরছিলেন সোনালী এবং নীলাঞ্জনবাবু। হঠাৎই সুচিত্রা সেনের মেকআপম্যান জামাল ভাই তাদের জানান তরুণ মজুমদারও সিনেমার জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন। এরপর সোনালীকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। একবার দেখেই শিপ্রাকে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ সিনেমার জন্য তাকে পছন্দ করে ফেললেন তরুণ মজুমদার। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই টলিউডে কাজের প্রথম সুযোগ পেয়ে গেলেন সোনালী। তখন থেকেই তার নতুন নাম হয় মহুয়া।
প্রথম ছবিতেই সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন মহুয়া। শুধুমাত্র চোখের এক্সপ্রেশনেই তিনি যেন কত কথা বলে দিতে পারতেন। অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় তাকে আগলে রাখতেন। সন্ধ্যা রায়ের কাছ থেকে অভিনয়ের অনেক কিছুই শিখেছিলেন মহুয়া। কিন্তু সন্ধ্যা রায় বলতেন, “মহুয়াকে কিছু শেখাতে হত না। আমি শুধু বলে দিতাম, আর ও তরতর করে বলে যেত। নাচ, অভিনয় ওর জন্মগত ছিল।”
টলিউডে আরেকজন ছিলেন মহুয়ার খুবই কাছের মানুষ। তিনি হলেন রত্না ঘোষাল। মহুয়া এবং রত্না খুব কাছের বান্ধবী ছিলেন। মহুয়ার জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন রত্না ঘোষাল। তিনিই বলেছিলেন মহুয়া ছিলেন তার বাড়ির সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তাকে দিয়েই রোজগার করানো হত। এরকমও দিন গিয়েছে তিন শিফটে কাজ করে বাড়ি ফিরে মহুয়া দেখেছেন বাবা নেশায় চুর হয়ে রয়েছেন। খাবার কিছুই নেই তার জন্য। উল্টে বাড়ি ফিরতেই নানা রকম খাবার বানানোর ফাই-ফরমাস খাটতে হত তাকে।
বাবার কাছে দিনের পর দিন অত্যাচারের শিকার হয়েছেন মহুয়া। তিনি নাকি বহুবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। তার মৃত্যুটাও স্বাভাবিক ছিল না। আসলে পর্দায় খুবই প্রাণবন্ত, হাসিখুশি দেখতে লাগলেও ভেতর ভেতর যেন ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন মহুয়া। তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল অশান্তিতে ভরা। তিনি বিয়ে করেছিলেন তিলক চক্রবর্তীকে। যদিও মহুয়ার বাবার এই বিয়েতে মত ছিল না। আসলে তিনি ভাবতেন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে টাকা হাতছাড়া হয়ে যাবে। মহুয়া তাই তিলকের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন সুন্দর একটা সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেই সংসারে আরও বেশি যন্ত্রণা অপেক্ষা করছিল তার জন্য।
আরও পড়ুন : শাশ্বত চ্যাটার্জীর মেয়েকে কেমন দেখতে? দেখুন ছবি
মহুয়া ছিলেন তার আমলের সবথেকে জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তার স্বামী তিলক তাকে সন্দেহ করতেন। রোজ অশান্তি হতো তাদের। স্বামীর হাতে বহুবার মার খেয়েছেন মহুয়া। তার গোটা শরীরে মারের কালশিটে পড়ে যেত। ব্যক্তিগত জীবনের জ্বালা ভুলতে তিনিও ক্রমশ মদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। মদ খেলেই যেন অন্য মানুষ হয়ে যেতেন মহুয়া। বহুবার স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসে মদ খেতেন। একটি সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে রত্না ঘোষাল বলেছিলেন মহুয়া মদের নেশাই তার একমাত্র ছেলে গোলাকেও মদ খাইয়ে দিতেন। রত্না বাঁধা দিলে বলতেন, “ওর বাবা মা খায়, আর ও খাবে না।”
অনেকে বলেন মহুয়ার বাবা এবং দাদু নাকি তার ছেলে গোলাকে মায়ের বিরুদ্ধে করে দিয়েছিলেন। তাকে বোঝানো হয়েছিল মা বিপথে গিয়েছে। যে রাতে মহুয়ার রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়, বাড়ি থেকে বলা হয় ছেলের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে স্টোভ বার্স্ট করে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঝলসে যায় মহুয়ার সারা শরীর। তখনও তার মুখে শুধুই গোলার নাম। রত্নাকে বলেছিলেন “গোলা রইলো, ওকে দেখিস।”
আরও পড়ুন : কোথায় হারিয়ে গেলেন ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র নায়িকা অঞ্জু ঘোষ?
আরও পড়ুন : বাংলা ছবির এই অভিনেত্রী দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের নাতনি
মহুয়ার মৃত্যুর পর অনেক প্রশ্ন উঠেছিল এই দুর্ঘটনা নিয়ে। অনেকে বলেন সেই রাতে নাকি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন মহুয়া। আবার কেউ কেউ বলেন তাকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। মৃত্যুর দিনও স্বামীর সঙ্গে তুমুল অশান্তি হয়েছিল তার। তারপরেই এই বিপত্তি। টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই বিশ্বাস করেন না মহুয়ার মৃত্যুটা নিছক দুর্ঘটনা ছিল। এর পেছনে অনেক কারণ ছিল। পরিবারের দাবি অনুসারে ঘটনা ঘটেছিল রান্নাঘরে, কিন্তু মহুয়ার শোয়ার ঘরের বিছানা ছিল পোড়া অবস্থায়। আর তাছাড়া মহুয়ার বাড়িতে রান্নার জন্য আলাদা লোক ছিলেন। তাই ছেলের জন্য দুধ গরম করতে মহুয়াকেই যেতে হবে এমনটাও ছিল না। কিন্তু মহুয়া নিজেই মৃত্যুর আগে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছিলেন স্টোভ বার্স্টের কথা। তাই আর কারও কিছু করার ছিল না। মহুয়া রায় চৌধুরীর মৃত্যুটা তাই আজও টলিউডের অন্যতম অমীমাংসিত রহস্য হয়ে থেকে গেল।