জানেন কি ডাক্তাররা সাদা রঙের পোশাক পরেন কেন?

ডাক্তার, উকিল, খেলোয়াড় প্রত্যেক পেশার জন্য নির্দিষ্ট পোশাক আছে। সাধারণত বিশেষ পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা বিশেষ ধরনের পোশাক পড়তে হয়। যেমন পুলিশ, উকিল, দমকল বিভাগের কর্মী, ট্রাফিক পুলিশ, সেনা, ডাক্তার এবং নার্সর ইত্যাদি।

ডাক্তাররা সাধারণত যে সাদা রঙের আপ্রন বা পোশাক পরে যা সাধারণত ল্যাবরেটরিতে থাকার সময় গবেষকরা ব্যবহার করে। সাধারণত চিকিৎসা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই ধরনের ল্যাব কোট পরে। এই ল্যাব কোট তৈরি হয় সুতির বা লিনেনের বা পলিয়েস্টার ধরনের কাপড় দিয়ে বা এইসব ধরনের কাপড়ের সংমিশ্রনে। আর তাই এই কাপড় পরিষ্কার করার সময় উচ্চ তাপমাত্রা ব্যবহার করা হলেও কাপড়ের গুণগত মানের কোন পরিবর্তন হয় না। আর সাদা রঙের পোশাক হওয়ার জন্য সহজেই বোঝাও যায়, ঠিক ভাবে পরিষ্কার হয়েছে কী না।

ডাক্তারদের এই সাদা পোশাক আসলে ল্যাবরেটরি  গবেষকদের পোশাক থেকে নেওয়া। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগের পূর্বে শুধুমাত্র যেসব বিজ্ঞানী বা গবেষক যারা ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে যুক্ত থাকতো তারাই শুধুমাত্র পরিধান করতো একধরনের ল্যাব পোশাক।

   

এই পোশাকটি ছিল হালকা গোলাপি বা হালকা হলুদ রঙের। সেইসময় ডাক্তারদের উপর সাধারণ মানুষদের বিশ্বাস আজকের মতো এতো বেশি ছিল না।

কারন হিসাবে এই ল্যাব গবেষকদের দায়ী করা যেতে পারে। কারণ তারা জনগনের কাছে তুলে ধরেছেন ওষুধ বা ড্রাগ দিয়ে তেমন কিছু মানুষের উপকারমূলক কাজ হয় না। যার ফলে ডাক্তারদের তুলনায় এইসব গবেষক ও বিজ্ঞানীদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আর তাই কিছুটা বাধ্য হয়ে ডাক্তারদের বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হতে হয় এবং তারাও চিকিৎসা করার আগে গবেষণার উপর জোর দিতে থাকে।

পরবর্তীতে সবাই ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে গবেষণাগারে যেসব জিনিস গবেষণা করা হয় তা থেকে এমন কিছু তৈরি করা যেতে পারে যা সত্যি সত্যি মানুষের রোগের চিকিসার কাজে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবে এবং বিভিন্ন রোগের সম্পূর্ন চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। আর তাই ডাক্তাররা নিজেদের গবেষক হিসাবে সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য শরণাপন্ন হন এই ল্যাব পোশাকের উপর। তারাও বিভিন্ন রোগের  চিকিৎসার জন্য গবেষণা করতো এবং গবেষণা করার সময় পরতে থাকে এই ল্যাব পোশাক।১৮৮৯ সাল থেকে ডাক্তাররা পাকাপাকি ভাবে এই ল্যাব পোশাক পরতে শুরু করে চিকিৎসা করার কাজেও। তবে তারা হালকা গোলাপি বা হালকা হলুদ রঙের বদলে সাদা রঙের পোশাক পরতে শুরু করে। সর্বশেষে বলা যেতে পারে কানাডার চিকিৎসক ড.জর্জ আর্মস্ট্রং(১৮ ৫৫-১৯৩৩) প্রথম বারের জন্য এই সাদা ল্যাব পোশাক  পরে চিকিৎসা করতে শুরু করেন কানাডার মন্ট্রিল জেনারেল হাসপাতালে। তিনি ছিলেন একজন শল্য চিকিৎসক। এছাড়াও তিনি ছিলেন কানাডার মেডিক্যাল আসোসিয়েশন এর সভাপতি।

তবে সাদা রঙের পোশাকই কেন ডাক্তাররা বেছে নিলেন?

সাদা রঙের পোশাক বেছে নেওয়া হয়েছিল চিকিৎসা ক্ষেত্রের নতুন স্ট্যান্ডার্ড প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

পবিত্রতা প্রদর্শন

আসলে সাদা রং হল পবিত্রতার প্রতীক ।আর তাই ডাক্তাররা যে চিকিৎসা করার সময় রোগীর কোন ক্ষতি করতে পারে না তা বোঝাতে সাদা রঙের পোশাককেই বেছে নেওয়া হয়।

উৎকৃষ্টতা প্রদর্শন

সাদা রঙের সাহায্যে উৎকৃষ্টতা প্রদর্শন করা যায়।সাধারণত যারা সকলের ভালো চান তারা সাধারণত সাদা পোশাকে নিজেদের আবৃত রাখেন ।যেমন  বিভিন্ন সাধু, গির্জার ফাদার ,এমনকি যীশুকেও সাদা পোশাকেও দেখা যায় ।আর তাই ডাক্তাররা যে সকল রোগীর ভালো চান ,তাদের নিঃস্বার্থ ভাবে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলতে চান তা বোঝাতে  সাদা রঙের পোশাক নিজেদের জন্য বেছে নেন।

পরিচ্ছন্নতা প্রদর্শন

সাদা রং হল পরিচ্ছন্নতার রং।এই রং যেমন একদিকে সকল খারাপকে দূরে সরিয়ে রাখে তেমনি চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরিচ্ছনতার যে বিরাট গুরুত্ব আছে তা বোঝাতে এই রঙের পোশাক  পরতে শুরু করেন ডাক্তারেরা।পরিচ্ছনতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের রোগমুক্ত রাখতে পারি তা ডাক্তারেরা তাদের সাদা পোশাকের মাধ্যমে সকলের কাছে প্রদর্শন করে।

সাদা শান্তির প্রতীক

সারা বিশ্ব জুড়েই সাদা রং কে শান্তির প্রতীক হিসাবে ধরা হয়।আর তাই ডাক্তাররা এই রংকেই বেছে নেয় রোগীদের মনকে শান্ত এবং নিজেদের শান্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে ।তাই রোগীদের মনের দুশ্চিন্তাও এই রঙের মাধ্যমে দূর করে তাদের মানসিক ভাবে আশস্ত করতে চেষ্টা করা হয় সাদা রঙের মাধ্যমে।

এছাড়াও এক সাদা পোশাক ব্যবহারের অন্য অনেক সুবিধা আছে। যেমন:

  • হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে এই সাদা পোশাক পরে থাকলে তা সহজেই রোগী এবং তার আত্মীয়দের থেকে ডাক্তারদের আলাদা করে চেনা যায়। ফলে সহজেই ডাক্তারও রোগীর মধ্যে পার্থক্য করা যায় ।
  • ডাক্তারদের এই সাদা পোশাকে বড় বড় পকেট থাকার জন্য সহজেই স্টেথেস্কোপ বা অন্যান্য কিছু নিয়ে যেতে ডাক্তারদের সুবিধা হয়।
  • এই সাদা পোশাক যেমন রোগ জীবাণু সংক্রমণ থেকে ডাক্তারকে রক্ষা করে তেমনি রোগীদের চিকিৎসা করার সময় অন্য রোগীদেরও সংক্রামিত করে না।
  • এছাড়াও সাদা পোশাক  শরীরের তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে এবং হাসপাতালের পরিবেশের সাথে সাদা পোশাক একদম মানানসই।
  • যদিও বর্তমানে একটি সার্ভে থেকে জানা গিয়েছে ৮২%শিশু চিকিৎসক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা করার সময় এই সাদা পোশাক পরতে পছন্দ করেন না।কারন তারা বলেন সাদা রঙের পোশাক শিশুদের এবং মানসিক রোগীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে।

হোয়াইট কোট সেরিমনি (White Coat Ceremony (WCC) কি?

এধরনের প্রথা বর্তমানে এক নতুন ধরনের প্রথা যা সাধারণত  মেডিক্যাল স্কুল বা কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয়।এটা শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে আমেরিকার শিকাগো  প্রিজকার স্কুল অফ মেডিসিন নাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।সাধারণত সারা বিশ্বে ১০০ এর বেশি মেডিক্যাল কলেজ বা স্কুল এই প্রথা উদযাপন করে ।সাধারণত এই  প্রথায় সাদা পোশাক দিয়ে সকল মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের নতুন চিন্তাধারা নিয়ে আনা হয় যে তারা এখন চিকিৎসা নামক এক মহান সেবা মূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত।এবং এই কাজের মর্যাদা রাখতে হবে তাদের ।