শ্রীকৃষ্ণ যাদব বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ও মাতা ছিলেন দেবকী এবং বসুদেব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মামার বাড়ি ছিল মথুরা। আর তার একমাত্র মামা ছিলেন কংস। শ্রীকৃষ্ণের মামার বাড়ির দাদু অর্থাৎ মাতা দেবকীর পিতা ছিলেন উগ্রসেন। আর তার মামা কংস, পিতা উগ্রসেনকে ক্ষমতার লোভে, সিংহাসন লাভ করার লোভে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। তারপর তার রাজ্যে সকল প্রকার অনিয়ম, অধর্মী কার্যকলাপ চলতে থাকে। প্রজাদের প্রতি অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
যাদব বংশের সঙ্গে ভোজ বংশের শত্রুতা ছিল বরাবরই। কিন্তু তবুও কংসের অত্যন্ত পরম মিত্র ছিল যদু বংশীয় রাজা বসুদেব। তাই কূটনৈতিক বিদ্যায় পারদর্শী কংস তার পরম মিত্র বসুদেবকে প্রস্তাব দেন তার প্রানের প্রিয় বোন দেবকীকে বিবাহ করার জন্য। যদিও বসুদেব প্রথমে এই প্রস্তাবে রাজি হন নি। কিন্তু তিনি পরে এই বিবাহের ফলে তাদের দুই রাজ বংশের মধ্যে চলতে থাকা শত্রুতা সমাপ্ত হয়ে যাবার যে নতুন দিক খুঁজে পেয়েছিলেন তার জন্য তিনি এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান।
ভগিনী এবং ভগ্নিপতি দেবকী এবং বসুদেবকে রথে চাপিয়ে রাজা কংস নিজে যদু রাজ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাদের সাথে একই রথে গমন করে। আর তখনই ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা, হঠাৎ আকাশ জুড়ে দৈববানী হয়, “দেবকী এবং বসুদেবের ঔরসজাত দেবকীর অষ্টম সন্তান কংসের হত্যাকারী হবে।”
এই কথা শোনা মাত্র রাজা কংস তার স্নেহের বোন দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। কিন্তু বন্ধু তথা দেবকী পতি বসুদেব রাজা কংসের কাছে দেবকীর প্রাণ ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। আর দেবকীর প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিনি তাকে বলেন, রাজা কংসের দেবকীর থেকে কোনো ভয়ের কিছু নেই, তার যা কিছু ভয় তা দেবকীর সন্তান থেকে, তাই তিনি দেবকীর হত্যা করে পাপের ভাগী যেন না হন, তার বদলে তিনি তাকে কথা দেন দেবকী এবং তাদের সন্তান যখনই ভূমিষ্ঠ হবে তখন তাকে তুলে দেওয়া হবে কংসের হাতে। এই কথায় কংস আসস্থ। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাদের বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, কংস যখন দৈববানী শুনে বুঝতেই পেরেছিল যে দেবকী এবং বসুদেবের অষ্টম সন্তান তার মৃত্যুর কারণ হবে,তবুও তিনি তাদের কারাগারে একই কক্ষেই রাখেন কেন? তিনি তো তাদের আলাদা আলাদা কক্ষে রাখলে দেবকীর গর্ভবতী হওয়ার অবস্থা তৈরি হতো না। তাহলে তো রাজা কংস নিশ্চিন্তভাবেই কোন রূপ চিন্তা ছাড়াই সহজেই রাজ্য শাসন করতে পারতেন। তার মৃত্যুভয় তৈরি হতই না। তবে তিনি কেন তা করেন নি? তিনি এরকম ভুল কেন করলেন?

প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে কংসের চরিত্রকে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী চরিত্রের। তার কাছে ভয় নামক কোনো বস্তু ছিল না। আর তিনি প্রজাদের উপর তার এইরকম একটা চরিত্র সদাই কায়েম রাখার চেষ্টা করতেন। দৈববানী যখন ঘটেছিল তখন সেই দৈববানী তিনি শুধুমাত্র নিজেই শুনতে পেয়েছিল তা কিন্তু নয়, সেখানে উপস্থিত দেবকী এবং বসুদেব সহ সকল উপস্থিত প্রজারাও শুনতে পেয়েছিল।
তাই তিনি প্রথমে প্রজাদের সামনেই দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, যাতে তিনি প্রজাদের মধ্যে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন যে তিনি নিজের প্রাণের রক্ষার জন্য সকল প্রকার কাজ করতেও সক্ষম তা তার আপন সম্পর্কের কেউ যদি তার ক্ষতি করতে চায় তাকেও রেয়াত করা হবে না। কিন্তু বসুদেবের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য দেবকী সেই যাত্রায় রক্ষা পান।
কিন্তু তিনি তাদের বন্দি করে নিজের কারাগারে রাখার কথা যখন সকল প্রজাদের সামনে ঘোষণা করেন, তখন প্রজাদের মধ্যে তার সম্পর্কিত পূর্বের ভীতি পুনরায় সঞ্চারিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি তার পরবর্তী সময়ে দেবকীর ছয় ছয়টি সদ্যজাত সন্তান আপন হাতে হত্যা করেছিলেন। তাই তার এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি তার প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রেখেছিলেন। আসলে তিনি দেবকী এবং বসুদেবকে কারাগারের একই কক্ষে রাখার মাধ্যমে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন প্রজাদের সম্মুখে। তিনি যে দৈববানীকে বেশি গুরুত্ব দেন নি তা প্রকাশ করার জন্য তিনি এই কাজ করেছিলেন বলেই অনেক পুরান বিশারদ মনে করেন।
এছাড়া আরও একটি কারণ এই হিসাবে উঠে এসেছে সেটা হল ভবিতব্য অর্থাৎ এই পৃথিবীতে সকল ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত। এই ঘটনা পরিবর্তন করার ক্ষমতা পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে আদি কালেও ছিল না আর বর্তমানেও নেই। তাই জন্মিলে মরিতে হবে তা যেমন ধ্রুব সত্য তেমনি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই। রাজা কংসের মৃত্যু শ্রীকৃষ্ণের হাতেই হবে তা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো ছিল না। তাই তার মৃত্যুর জন্য যে যে ঘটনা ঘটেছে তা একপ্রকার ভবিতব্য ছিল। সেখানে কংসের নিজেকে শ্রীকৃষ্ণের হাত থেকে বাঁচানোর কোন ক্ষমতা ছিল না। তাই তিনি নিয়তির দ্বারা এইভাবেই নিজের পরিণতি ডেকে এনেছেন।

আরও পড়ুন :- কংস দেবকীর যে ৬টি সদ্যজাত সন্তান হত্যা করেছিলেন তারা কারা?
আবার অন্য মতে কংস অত্যন্ত সুপণ্ডিত ছিলেন তিনি যখন জানতে পারেন তার মৃত্যু দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের দ্বারা হবে এবং সেই সন্তান হবে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তখন তিনি একপ্রকার মন থেকে মেনে নিয়েছিলেন তার শেষ পরিণতি। কিন্তু ঈশ্বরের হাতে মৃত্যু হলে তার যে জীবনের চরম সকল পাপ ধুয়ে যাবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর তার নাম ইতিহাসে অমর হয়ে যাবে। তাই তিনি এরকম কাজ করেছিলেন সবকিছু জেনে বুঝেও।
উপরের বর্ণিত মতামত বিভিন্ন শাস্ত্র খুঁজে নেওয়া হয়েছে। যদি কারো এই মতের সাথে নিজের মতের অমিল হয়, তাহলে উপযুক্ত প্রমান সহ আমাদের জানান কমেন্ট বক্সে। আমরা তা আমাদের দেওয়া মতের সাথে তুলে ধরবো।