কৃষি বিল কি এবং কৃষকরা এই বিলের বিরোধিতা করছে কেন?

কেন্দ্র তিনটি কৃষি বিল পেশ করেছে। এই বিলগুলি হল ‘অত্যাবশ্যক পণ্য আইন’ সংশোধন, ‘কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন’ এবং ‘কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত রাখতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি’ বিল। তিনটি বিলই লোকসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে।

What is the Farm Bill and why are farmers protesting against it
What is the Farm Bill and why are farmers protesting against it

কৃষক আন্দোলনে উত্তাল দেশ। বিদ্রোহের আগুনে উত্তপ্ত রাজধানী দিল্লী। বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান,হরিয়ানা,পাঞ্জাবের লাখ লাখ কৃষক (Farmers)। সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের এমন আন্দোলন (Farmers Protest) কারণ কি?

এর মূল কারণ নতুন কৃষি আইন (Farmers Act 2020)। মোদী সরকার সম্প্রতি তিনটি নতুন আইন পাশ করিয়েছে যা নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে কৃষকদের মনে। এই আইন প্রত্যাহারের দাবিতেই পথে নেমেছেন তারা এবং এইক্ষেত্রে কোনওরকম আপোষ মেনে নিতেও নারাজ তারা। নতুন কৃষি আইন নিয়ে ঠিক কোন কোন বিষয় সমস্যা তৈরি হয়েছে?  তা জানার আগে জানতে হবে আইন গুলির মূল কথা কি।

১. ফার্মার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স আইন ২০২০

এই আইন অনুযায়ী (Promotion and Facilitation Bill 2020) এখন থেকে দেশজুড়ে চাষীরা রাজ্য সরকারের নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত গণ্ডি এবং বাজারগুলোর বাইরে দেশের যেকোনও অংশে তাদের উৎপন্ন করা পণ্য বিক্রি করতে পারবেন এবং তার জন্য তাদের কোনও অতিরিক্ত কর বা ফি দিতে হবেনা। আগে এপিএমসি (APMC) তথা কৃষিপণ্যের বিপণন কমিটি আইন অনুযায়ী চাষীরা তাদের উৎপন্ন করা কৃষিপণ্য কেবলমাত্র রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজারেই বিক্রি করতে পারতেন, কিন্তু এখন এই গণ্ডি করিয়ে দেওয়া হলো।

২. ফার্মার্স এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসিওরেন্স

এই আইন অনুযায়ী (Farmers Agreement on Price Assurance) কৃষকরা এখন থেকে প্রয়োজন হলে যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি কোম্পানীর সাথে ফসল উৎপাদনের আগে বা পরে চুক্তি করতে পারবেন। আগে কৃষকরা কোনও সংস্থার সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারতেন না

৩. কৃষি পরিষেবা আইন ২০২০ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ২০২০

এই আইন অনুযায়ী প্রধান কৃষি পণ্যগুলির মজুত ও সরবরাহের ক্ষেত্রে আর কোনরকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবেনা। এইধরনের কৃষি পণ্যের মজুদ ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হবে বাজার দ্বারা। তবে কখনও কোনও জরুরি অবস্থা জারি হলে বা অন্য কোনও সংকট (বন্যা, খড়া বা অন্য কোনও বিপর্যয়) হলে সরকার মজুদ নিয়ন্ত্রন করতে পারবে।

কৃষক আন্দোলন কীভাবে শুরু হল?

এই আইনগুলোর বিরুদ্ধে পাঞ্জাব বিধানসভায় সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করানো হয়েছে যাতে বলা হয়েছে পাঞ্জাব কেন্দ্রের এই তিনটি আইনের আওতায় থাকবেনা। কিন্তু হরিয়ানার বিজেপি সরকার এই দাবিতে রাজি না হওয়ায় ভারতীয় কৃষক ইউনিয়নের নেতা নেতা গুরনাম সিংহ চাদুনির নেতৃত্বে বৃহত্তর আন্দোলনে নেমেছেন কৃষকরা। দেশের সব কৃষক সংগঠনরাও এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন।

কৃষক আন্দোলনের কারণ কি?

মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের বড় অংশ এই আইনগুলোর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তবে দেশের সব অংশের কৃষকরা (Farmer) এই আইনের বিরোধিতা করছেন না। এই বিদ্রোহের মূল কারণ সরকারি সহায়তা বন্ধ হওয়া। কৃষকদের বক্তব্য, এর ফলে কৃষকদের (Farmer) বড় বড় কর্পোরেট হাউসের অধীনে বাঁচতে হবে এবং এই আইন গুলির ফলে আগে কৃষকরা (Farmer) কৃষিপণ্য চাষ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে যে ন্যূনতম অর্থ সাহায্য পেতেন তা পাওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। এক কথায় তাদের বক্তব্য এই আইন গুলির ফলে কৃষির বেসরকারিকরণ ঘটবে।

কৃষক আন্দোলন কারা করছেন?

তবে শুধু কৃষকই (Farmer) নয়, এই আইনের বিরোধিতায় নেমেছেন এক শ্রেণীর মধ্যসত্ত্বভোগী। দেশের অনেক অংশেই কৃষকদের (Farmer) সাথে বাজারের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। এক্ষেত্রে এই মধ্যসত্ত্বভোগীরা বড় ভূমিকা পালন করেন। তাদের আশঙ্কা এই আইনের ফলে পেটে লাঠি পড়বে তাদের, ফলে তারাও এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছেন।

রাজ্য সরকার এই আইনের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। তারা মনে করছেন, এই আইনের ফলে তাদের রাজস্ব ক্ষতি হবে। এপিএমসি মান্ডিগুলো থেকে সরকার কর বা ফি পায়। এই নতুন আইন মান্ডিগুলোর গুরুত্ব কমাবে এবং কৃষকরা (Farmer) মান্ডির বাইরে স্বাধীন ভাবে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবেন। স্বাভাবিক ভাবেই এর প্রভাব রাজস্বে পড়বেই।

কৃষকদের এই বিলের বিরোধিতা করার কারণ?

কর্পোরেটের হাতে টাকা এবং ক্ষমতা দুইই বেশী। এছাড়াও সেখানে কথা শোনার মতন কেউ নেই। রাজনৈতিক প্রভাব সবথেকে বেশী পরে।তারা সহজেই চাষীদের (Farmer) বোকা বানাতেই পারে।সব চাষীদের পুঁথিগত শিক্ষাও কর্পোরেট সংস্থার প্যাচ বোঝার মতন নয়।এছাড়াও তাদের বক্তব্য অনুযায়ী স্বাভাবিক ভাবেই যেকোনও কর্পোরেট সংস্থাই চাইবে বড় কৃষকদের (Farmer) সাথে চুক্তি করতে। এর ফলে বাজে অবস্থায় পড়বেন ছোট কৃষকরা (Farmer)।এর ফলেই তাদের দাবি, এখনই তিনটে আইনই বাতিল করতে হবে।

১) ফসলের দাম কৃষকরা ঠিক করতে পারবে না। এই দামের নিয়ন্ত্রণ দালাল ও ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে। যার ফলে কৃষক দাম চাইলেও নায্য দাম পাবে না।

২) পুরো কৃষি ব্যবস্থা চলে যাবে ব্যবসায়ীদের হাতে। ফসল উৎপাদন থেকে বিক্রি নিয়ন্ত্রণ থাকে ব্যবসায়ীদের হাতে।

৩) কৃষিপণ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বড়সড় বিপদ আনতে পারে কৃষকদের জীবনে। কারণ দেশের এখনও অধিকাংশ কৃষকের এই বিদেশি বিনিয়োগ সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই। আর এই বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ নিতে পারে দেশের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা।

কেন্দ্রের বক্তব্য

  • কেন্দ্রের কথা অনুযায়ী সরকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে কোনোভাবেই সহায়ক মূল্য দেওয়া বন্ধ হবেনা।এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারমন (Nirmala Sitaraman) ত্রিপুরার কথা বলেছেন যে বাম আমলে চাষীরা (Farmer) সেখানে কোনরকম সহায়ক মূল্য পেতেন না কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে তারা সহায়ক মূল্য পান।
  • এছাড়াও এই আইনের মধ্যে দিয়ে পণ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে কৃষকদের (Farmer) সম্পূর্ন স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে।যদি কৃষকরা (Farmer) চুক্তি করেন সেক্ষেত্রে চুক্তি চাষের ক্ষেত্রেও সমান অধিকার থাকবে কৃষকদের। তারা যেকোনও সময় চাইলে চুক্তি ভেঙে দিতে পারেন। তবে যদি কর্পোরেট ক্রেতা চুক্তি ভাঙ্গে বা চুক্তির শর্ট উলঙ্ঘন করে সেক্ষেত্রে জরিমানা দিতে হবে এবং চাষীদের (Farmer) নির্ধারিত মূল্য দিতে হবে।
  • দেশ জুড়ে ১০ হাজার ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (Farmer-Producer Organization) গড়ে তোলা হবে।এই ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশনের কাজ হবে ক্ষুদ্র চাষীদের সাথে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দর কষাকষিতে সাহায্য করা।
  • এছাড়া কৃষকরা (Farmer) সরাসরি ক্রেতাকে কৃষি পণ্য বিক্রি করার সুযোগ পাবে, ফলে কোনও কাটমানি, লেভি বা ফি দেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনা।সরকারের কথায় এপিএমসি (APMC) বাজারে স্বচ্ছতা আসবে কারণ এই আইনগুলো বাজারে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করবে।