মা লক্ষ্মী হলেন সৌভাগ্য ,সম্পদ এবং সৌন্দর্যের দেবী। মা লক্ষ্মী খুবই চঞ্চলা অর্থাৎ এক জায়গায় তিনি বেশিক্ষণ স্থায়ী ভাবে থাকতে পারেন না। তাই মা লক্ষীকে ঘরে স্থায়ীভাবে রাখতে গেলে আমাদের করতে হয় বেশ কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি। যে সব পদ্ধতি অবলম্বন করলে এবং মা লক্ষ্মীকে শুদ্ধ মনে শুদ্ধ বস্ত্রে ভক্তিভরে পূজা করলে তবে তিনি ভক্তদের ঘরে স্থায়ীভাবে অধিষ্ঠান করেন।
প্রথমত মনে রাখতে হবে মা লক্ষ্মী যদিও ধনের দেবী কিন্তু তিনি অবশ্যই প্রথমে মর্যাদা দেন কর্মকে অর্থাৎ কর্ম না করে যদি কেউ ধনের আশা করেন তাহলে কিন্তু মহালক্ষ্মী তার ওপর কৃপা বর্ষণ করেন না। তাই প্রথমেই আপনার কর্মের প্রতি সততা রাখতে হবে।
মা লক্ষ্মীর উত্পত্তি
মা লক্ষ্মী কে আমরা জানি ভগবান নারায়নের পত্নী হিসাবে। কিন্তু ভারতীয় বিভিন্ন পুরাণ ঘাঁটলে দেবী লক্ষীর উৎপত্তি সম্পর্কে নানান তথ্য পাওয়া যায়। এই সমস্ত তথ্য একদিকে দেবী লক্ষীর উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের নানান দিক তুলে ধরে, তেমনই দেবী লক্ষ্মীর সৃষ্টি এবং কল্যাণকর রূপকেউ সকলের সামনে তুলে ধরে।বিষ্ণু পুরাণ, পদ্মপুরাণ, গরুর পুরান এবং বায়ু পুরাণ অনুযায়ী যে সকল তথ্য আমরা পাই সে সকল তথ্য আজ আমরা তুলে ধরব মা লক্ষ্মীর উৎপত্তি সম্পর্কে।
পুরাণ অনুযায়ী মা লক্ষ্মীর উত্পত্তি
লক্ষ্মী হলেন প্রসূতি গর্ভে দক্ষকন্যা অর্থাৎ দক্ষ রাজার পত্নীর সন্তান রূপে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এছাড়াও তাকে খ্যাতির গর্ভে ভৃগু কন্যারূপেও জন্ম গ্রহণ করতে অনেক পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও আর একটি প্রচলিত গল্প অনুযায়ী আমরা জানতে পারি ভগবান নারায়ণের পত্নী লক্ষ্মীর উৎপত্তি সম্পর্কে।
দুর্বাসা মুনি ও ইন্দ্র
এই গল্প অনুযায়ী একবার মুনি দুর্বাসা তার নিজে বরযুক্ত পারিজাত মালা প্রদান করেন দেবরাজ ইন্দ্রকে। দেবরাজ ইন্দ্র সেই মালার গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন এবং তিনি তখন সেই মালা তার বাহন ঐরাবত কে পরিয়ে দেন। কিন্তু ঐরাবত সেই মালা তার শুড়ে করে মাটিতে ফেলে দেন এবং পরবর্তী সময়ে পদদলিত করেন। তখন তার বরযুক্ত মালা মাটিতে পদদলিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে মুনি দুর্বাসা প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হন।
দুর্বাসার অভিশাপ
দেবরাজ ইন্দ্রকে তিনি অভিশাপ প্রদান করেন যে তিনি তার শ্রীযুক্ত মালা ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করার জন্য তার তিনলোক লক্ষীছাড়া হবে। ঋষি দুর্বাসার মুখ থেকে এই অভিশাপ বাণী নিঃসৃত হলে মা লক্ষ্মী দেবরাজ ইন্দ্রের দেবলোক পরিত্যাগ করে পাতাল লোকে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন। পরবর্তী সময়ে দেবতা এবং অসুর মিলে যখন সমুদ্র মন্থন করেন তখন সমুদ্রগর্ভ থেকে দেবী লক্ষ্মী পুনরায় উত্থিত হন এবং দেবতারা পুনরায় তাকে ফিরে পান।
দেবী সরস্বতীর আবির্ভাব
অন্য একটি কাহিনী অনুযায়ী দেবী লক্ষ্মীর সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থানের পূর্বে দেবী সরস্বতী সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থান করেন অর্থাৎ দেবী সরস্বতী প্রথমে আবির্ভূত হন এবং এই দেবী সরস্বতী থেকে সমস্ত ঋষিগণ এবং দেবতারা জ্ঞান লাভ করেন। তখন মহর্ষি ভৃগু এক প্রশ্ন সকলের সামনে উপস্থাপন করেন।
তিনি জানান ,”আমরা সকলেই তো দৈব জ্ঞান লাভ করেছি, কিন্তু জ্ঞান লাভ করলেই আমরা আমাদের ক্ষুধা তো নিবারণ করতে সক্ষম হচ্ছি না। অর্থাৎ আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে, নইলে সকলের যে অকাল মৃত্যু ঘটবে।” তাই তিনি সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন ক্ষুধার অর্থাৎ অন্নের দেবী এবং শষ্যের দেবীর সন্ধানে। এইভাবে সন্ধান করতে করতে তিনি শস্যের দেবী অর্থাৎ অন্যের দেবী লক্ষ্মীর সন্ধান পান।
দেবসেনাপতি কার্তিক এর স্ত্রী
এছাড়াও কিছু পুরাণ অনুযায়ী পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেবী লক্ষ্মী দেবসেনাপতি কার্তিক এর পত্নী রূপে আবির্ভূত হন বলেও জানা যায়। এছাড়াও জানা যায় শাস্ত্রমতে ভগবান বিষ্ণু যখন বামন রূপে পৃথিবীতে অবতার নেন, সেই সময় দেবী লক্ষ্মী লাল পদ্ম থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এছাড়াও জানা যায় ভার্গ যখন রাম রূপে জন্মগ্রহণ করেন তখন দেবী লক্ষ্মী তার ঘরনী রূপে অধিষ্ঠান করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি রামায়ণে সীতা রূপে আবির্ভূত হন এবং পরবর্তী সময়ে ভগবান বিষ্ণু যখন কৃষ্ণ রূপে অবতার নেন তখন তিনি রুক্মিণী রূপেও আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এছাড়াও তাকে ভগবান শ্রী হরির বক্ষ স্থলে অধিষ্ঠাত্রী হরিপ্রিয়া নামেও অবতীর্ণ হতে শোনা যায়। দেবী লক্ষ্মীর যে স্বাভাবিক রূপ আমরা দেখতে পা তাতে আমরা দেখতে পাই তিনি কখনও দুই হাতে অবতীর্ণ হয়েছেন আবার কখনো তিনি চতুর্ভূজা অর্থাৎ চার হাতে অবতীর্ণ হয়েছেন। যখন তিনি দুই হাতে অবতীর্ণ হয়েছেন তখন তার এক হস্ত জ্ঞান এবং অন্য হস্ত কর্মকে সূচিত করে। চতুর্ভূজা অবতারে তার চারটি হাত নির্দেশ করে জ্ঞান, অর্থ ,কর্ম এবং মোক্ষকে।
দেবীকে আমরা দেখতে পাই কখনো এক লক্ষী রূপে আবার তিনি অনেক জায়গায় অষ্টলক্ষী রূপে অবস্থান করেন। দেবীর অধিষ্ঠান আমরা দেখতে পাই পদ্ম ফুলে বিল্ব পত্রে এবং হস্তী কপালে,এবং গোমাতার পৃষ্ঠে এবং মানুষের অঙ্গুলি শীর্ষেও দেবী লক্ষ্মী অবস্থান করেন।
এছাড়াও আরেক মত অনুযায়ী জানা যায় দেবী লক্ষ্মী গোমুত্রে এবং গোময় অধিষ্ঠান করেন ।এই গল্পটি যা জানা যায় তা হল, গোমাতার মধ্যে সকল দেব দেবীর অধিষ্ঠান করেন। সেই রকমই দেবী লক্ষ্মীও গোমাতার মধ্যে অধিষ্ঠান করতে চান, কিন্তু দেবী লক্ষ্মী চঞ্চলা হওয়ার দরুন গোমাতা তাকে তার দেহে অধিষ্ঠান করতে জায়গা দেন না ।তাই দেবী লক্ষ্মী এক প্রকার বাধ্য হয়ে গোমূত্র এবং গোময় অবস্থান করেন।