ব্যবিলনে ছিল ঝুলন্ত বাগান। আমাদের দেশে রয়েছে ঝুলন্ত পিলার বা থাম। এই ঝুলন্ত থামের মন্দির রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার লেপক্ষী গ্রামে। শিবের বিধ্বংসীরূপ ভগবান বীরভদ্রের এই মন্দিরটি লেপক্ষী মন্দির নামেও পরিচিত। মন্দিরের ৭০টি থামের মধ্যে একটি থাম উপর থেকে ঝুলছে। মাটি স্পর্শ করেনি। যা আশ্চর্যের বিষয়। আধুনিক স্থপতিরাও এই মন্দিরের গঠন রহস্য ভেদ করতে পারেননি। এই নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। তৈরি হয়েছে নানান উপাখ্যান। এক ব্রিটিশ স্থপতি একটি পিলারের অংশ ভাঙ্গার চেষ্টা করেন গঠনশৈলী বোঝার জন্য। কিন্তু সফল হননি। এরপর অনেক প্রকৌশলীই এর নির্মাণ রহস্য ভেদ করতে চেয়েছেন। কিন্তু সফল হননি।
পুরো মন্দির গ্রানাইট পাথরে তৈরি। তিনটি প্রবেশদ্বার। উত্তরমুখো প্রবেশদ্বারের শীর্ষে রয়েছে গোপুরা। এটিই ঢোকার মূল পথ। দক্ষিণ ভারতীয়রা বলেন ‘গোপুরা’ অর্থাৎ স্মারক মিনার। ‘গোপুরাম’ শব্দ থেকে ‘গোপুরা’ শব্দটি এসেছে। সাধারণত তামিলনাড়ু, অন্ধ্র্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটকা ও কেরালা রাজ্যের মন্দিরগুলোর প্রবেশদ্বারে স্মারক মিনার থাকে।
দ্বিতীয় ঘেরাওয়ের কেন্দ্রে মূল মন্দির। এটিও উত্তরমুখী। এর দুটি মূল অংশ। একটি ‘গর্ভগৃহ’ এবং অন্যটি ‘অন্তরাল’। এদেরকে ঘিরে রয়েছে ‘প্রদক্ষিণ’, ‘মুখ মণ্ডপ’ ও ‘পিলার করিডোর’। করিডোরের ঝুলন্ত পিলার বা স্তম্ভগুলোর জন্যই এই মন্দিরের নামডাক। সমস্ত রহস্য, আকর্ষণ ও জনপ্রিয়তা। সাধারণত বাড়ি বা ভবন দাঁড়িয়ে থাকে পিলারের জোরেই। এই মন্দিরে ঠিক তার উল্টো। দেখে মনে হয়, পিলারগুলো কোনোরকমে ঝুলছে। নিচে বেশ খানিকটা ফাঁকা। অনেক পূণ্যার্থীকে ওই ফাঁকা জায়গা দিয়ে শাড়ি, কাপড় বা ধূপকাঠি আনা-নেওয়া করেন। বিশ্বাস, কোনওরকম বাধা ছাড়া আনা-নেওয়া করা গেলে মানত পূরণ হয়।
আরো পড়ুন : ভারতের ১০টি সবচেয়ে ধনী মন্দিরের নাম ও তাদের ধন সম্পদের পরিমান
মুখমণ্ডপের ডানদিকে পূর্বমুখো বিষ্ণু, এর দক্ষিণে মুখ করে শিব এবং পশ্চিমমুখী করে পার্বতী অর্থাৎ দূর্গামন্দির। প্রদক্ষিণের পশ্চিম দিকে গর্ভগৃহ ও অন্তরাল ঘেরা বীরভদ্র মন্দির। এর মধ্যেও রয়েছি তিনটি মন্দির- রামলিঙ্গ, ভদ্রকালী ও হনুমানলিঙ্গ।
দ্রাবিড়ি শীল্পশৈলিতে বানানো মন্দিরের বেশিরভাগ পিলারগুলো মহামণ্ডপের করিডোর থেকে ঝুলে রয়েছে। প্রতি পিলারে হাজারো দেব-দেবীর খোদাই করা প্রতিকৃতি। এর মধ্যে ব্রহ্মা, নারদ, রম্ভা, পদ্মিনী, নটরাজ, গণেশ, নান্দী, লক্ষ্মী, নরসিংহ উল্লেখযোগ্য। মূলমণ্ডপ ও মহামণ্ডপের সিলিংগুলো বিজয়নগর আমলের চিত্রকর্মে অলঙ্কৃত।
আরো পড়ুন : ভারতের সবচেয়ে পবিত্র ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ এর নাম, অবস্থান ও তাদের সৃষ্টির ইতিহাস
নাম-কারণ ও নন্দী মূর্তি
স্থানীয় ভাষায় ‘লে পক্ষী’ শব্দের অর্থ ‘রাইজিং বার্ড’ বা ‘ওঠো পাখি’। কথিত আছে, সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় এখানেই জটায়ু রাবণকে বাধা দিয়েছিলেন। রাবন তখন খড়্গ দিয়ে জটায়ুর ডানা কেটে দেন। মন্দির থেকে রামের পদচিহ্ন পাওয়া গেছে। সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে এখনে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন রাম। আহত জটায়ুকে দেখে রাম বলেছিলেন, ‘ওঠো পাখি’। সেই থেকেই এই জায়গার নাম ‘লেপক্ষী’। এই মন্দির থেকে ২০০ মিটার দূরেই অবস্থিত ভারতের বৃহত্তম নন্দী মূর্তি। ২৭ x ১৫ ফুট উঁচু। একটি পাথর কুঁদে বানানো। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গের একেবারে সোজাসুজি রয়েছে নন্দী মূর্তিটি। শিবলিঙ্গকে ছায়া দিচ্ছে একটি বৃহদাকার সাপ।
আরো পড়ুন : ভারতের ১০টি সবচেয়ে ধনী মন্দিরের নাম ও তাদের ধন সম্পদের পরিমান
মন্দিরের স্থাপত্য কৌশল এবং ঝুলন্ত স্তম্ভ
ষোড়শ শতাব্দীর প্রাচীন এই মন্দিরের ৭০ টি থাম। প্রত্যেক থামের গায়ে অসামান্য কারুকাজ। খোদাই করা নানা মূর্তি। তবে অবাক করা বিষয় হয়, একটি থাম মাটি স্পর্ষ করেনি। মাটি থেকে প্রায় ১ ইঞ্চি ওপরে এসে শেষ হয়ে গিয়েছে পিলারটি। যার নীচ দিয়ে অনায়াসে গ্লিয়ে দেওয়া যায় টুকরো কাপড় বা কাগজ। ১৯১০ সালে বিদেশ থেকে আগত এক দল আর্কিটেক্ট বীরভদ্র মন্দিরে মাপ-জোখ করেছিলেন। তখনই একজনের নজরে আসে ঝুলন্ত থামের দিকে। তাঁরা ভেবেছিলেন, কোনও ভূমিকম্পের ফলে পিলারটি মাটি থেকে ছেড়ে গেছে। তাঁরা অবিলম্বে থাম ঠিক করার ব্যবস্থা নিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ হল না।
তাঁরা ভাবলেন ঝুলন্ত পিলারটিকে ছাদ থেকে খুলে যদি মাটিতে সোজা করে লাগানো যায়। কিন্তু পিলারটি একটু নড়তেই অন্য পিলারগুলিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পুরো মন্দিরটাই হেলে গেছে একদিকে। যেন সমগ্র মন্দিরটি ধসে পড়বে এখনি। পরবর্তীকালে তিনি অন্য আর্কিটেক্টদের সুবিধার জন্য একটি কাগজে রিপোর্ট লেখেন, যেন ঝুলন্ত থামটিকে নড়ানো না হয়। নাহলে মন্দিরের ভেঙে পড়া কেউ আটকাতে পারবে না।
আরো পড়ুন : ভারতের রহস্যময় ও অলৌকিক ৯ মন্দির
তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও স্থপতিকার বা ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায় আসেনি, কীভাবে কোনও কিছুর ওপর ভর না দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী দাঁড়িয়ে রয়েছে ঝুলন্ত থামটি। কথিত আছে, রাজার অনুমতি ছাড়াই বীরুপান্না রাজকোষ থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে মন্দিরের নির্মান কাজ শুরু করেছিলেন। রাজা অচ্যুতরায় যখন জানতে পারেন রাজকোষ তখন প্রায় শূণ্য। রাজা রেগে গিয়ে বীরুপান্নাকে অপমান করে বলেন চোখ উপড়ে নেবেন। অপমানিত বীরুপান্না নিজেই নিজের চোখ উপড়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এই মন্দিরে। এখনও দেখা যায় সেই রক্তের দাগ। শুভ স্থানে রক্তের দাগ থাকায় রাজা আর মন্দিরটি সম্পূর্ণ করেননি।