রোজই আমরা শুনি কোনো না কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক মহাশয়ের প্রহারে ছাত্র বা ছাত্রী আহত হচ্ছেন।আর পুলিশ এসে শিক্ষককে বা শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্চেন।আবার এও দেখতে পাচ্ছি ছাত্র এসে প্রধান শিক্ষিকাকে গুলি করেও মারছেন।আজ সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে শিক্ষক মহাশয়দের ছাত্রদের শিক্ষাদান। বেশ কিছু বছর আগেও শিক্ষক মহাশয়দের শিক্ষাদানে ছাত্রছাত্রীদের দণ্ডদানে কোনো বাধা ছিল না। ছাত্র পড়া না পারলে বা করলে যেমন তিরস্কার করা হত, তেমনই ভালো ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কৃত করাও হত। বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানে শিক্ষকরা উৎসাহ পেত। প্রতি ক্লাসে ৫০ বা ৭০ টা ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি থাকলেও ক্লাস চলাকালীন সবাই আগ্রহ সহকারে শিক্ষক মহাশয়ের কথা শুনত তা ভয়েই হোক আর ভক্তিতে।
কিন্তু বর্তমানে যখন থেকে দৈহিক শাস্তিদান এক অপরাধ বলে রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ জারি করল তখন থেকেই প্রত্যেক বিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণের মান কমতে লাগল।আমি কিন্তু কোনো ভাবেই দৈহিক শাস্তিদানকে শিক্ষা ব্যবস্থায় অত্যন্ত দরকার বলছি না।তবে ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি ,শিক্ষকরা এখন শিক্ষাদানে উৎসাহ হারাচ্ছে।একটা ক্লাসে প্রথম দুই বা বড়জোর তিন বেঞ্চের ছেলেরা বিদ্যালয়ের পড়াশোনা সম্বন্ধে সচেতন।বাকিরা জানেই তাদের বাবা মায়েরা তাদের প্রতিটি বিষয়ে আলাদা আলাদা গৃহ শিক্ষক দিয়েছে।তাই তারা বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে আসে না, আসে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ফূর্তি করে সময় কাটাতে।শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক যখন দেখছে শিক্ষার্থীরা তার দেওয়া পাঠদান নিতে আকর্ষিত বোধ করছে না তখন শিক্ষক অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করার চেষ্টা করছে।শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করে তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।কিন্তু ফল হচ্ছে তার উল্টো,ছাত্রেরা বিভিন্ন গল্প করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে সুকৌশলে। এছাড়াও পাঠদান ছাড়াও নানান সহকারী কাজে যেমন মিড ডে মিল, কন্যাশ্রী, চাইল্ড রেজিস্টার, ভোটার কার্ড সংশোধন ও আরও অনেক কিছুতে শিক্ষকরা নিযুক্ত হয়ে পড়ায় ,পাঠদান ধীরে ধীরে গৌণ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকতা যেন ১০টা থেকে ৫টার সরকারি চাকরির মতোই হয়ে যাচ্ছে।আজ শিক্ষকদের গ্রূপে,স্টাফরুমে বা টিচার কমন রুমে একটাই আলোচ্য বিষয় ডি. এ কেন বাড়ছে না? কেন ট্রান্সফার পাচ্ছি না? শিক্ষকতার চাকরি পাবার আগে একজন শিক্ষক যতোটা আগ্রহে তার ব্যক্তিগত পড়াশোনা করেছিল ,শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তার সিকি ভাগও তারা দিতে পারছে না।তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে আর থাকবেও। এতো সবের পরও বেশ কিছু শিক্ষক আছেন যারা তাদের ছাত্রদের শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য নানা বিকল্প পথ অবলম্বন করেন।
তেমনই এক অভিনব পথ বেছে নিয়েছেন তামিলনাড়ুর বিল্লুপুরামের এক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জি. বালু।তিনি সকল ছাত্রদের সামনে হাত জোড় করে হাঁটুর উপর ভর করে বসে পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য অনুরোধ করছেন।তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন একবার তার বিদ্যালয়ের ৬৫% ছাত্রছাত্রী পাশ করা সত্বেও তিনি দেখেন যে দ্বাদশ শ্রেণীর মাত্র ২৫% পাশ করেছে। তখন তিনি প্রচন্ড রকম ভাবে হতাশ হন এবং তিনি ওই ফেল করা ছাত্রদের অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে আসার জন্য নোটিশ দেন।পরে ওই ছাত্রছাত্রীরা তাদের অভিভাবক নিয়ে আসলে, তাদের সামনে তিনি হাঁটুর উপর বসে হাত জোড় করে ওইসব ছাত্রদের আরও ভালো করে পড়াশোনা করার জন্য বলেন।এর ফলে দ্রুত কাজ হয় ওইসব ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশি সচেতন হয়ে যায় তাদের পড়াশোনায় এবং পরের বছর পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করে।এই সব দেখে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে এবার থেকে প্রত্যেকবার পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি প্রত্যেক ছাত্রদের কাছে এই একই রকম ভাবে ভালো করে পড়াশোনা করার অনুরোধ জানাবেন।
তিনি বলেন তার এই পদ্ধতি অন্য অনেক শিক্ষকদের খারাপ লাগতে পারে কিন্তু তার ৩০ বছরের শিক্ষাজীবনে তিনি এটা ভালো করেই বুঝেছেন যে বিদ্যালয়ের সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রও শিক্ষকের প্রেম ও ভালোবাসা পেলে বদলে যায়। তিনি বলেন আমাদের শিক্ষকদের ধৈর্য্য ও সহনশীলতা অনেক বাড়াতে হবে।তিনি বলেন যে গ্রামের দিকের ছেলেমেয়েরা আর্থসামাজিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকায় তারা শিক্ষা গ্রহণের আকর্ষণ রাখতে পারে না।তার চেয়ে তারা দিন টাকা রোজগারের কথা ভেবে শিক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।তাই এইসব ছাত্রদের যদি পড়াশোনা শেখানোর জন্য দৈহিক পীড়ন বা মানসিকভাবে তাদের অপমানিত করা হয় তাহলে তারা আরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে উঠবে।তাই তাদের সঠিক পথ দেখানোর জন্য তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।আর ভালোবাসার মাধ্যমে তা সহজেই অর্জিত হয়।
তিনি বলেন যে শিক্ষাগ্রহণ করে সবাই যে চাকুরি পাবে তা তিনি বলতে পারেন না কিন্তু ভালোবাসার শিক্ষা ভবিষ্যতে ছাত্রদের উন্নত চরিত্র গড়তে সাহায্য করবে।আর ভালো চরিত্রের মানুষদের দ্বারা ভালো দেশ গড়া সম্ভব।একজন মানুষ তখনই প্রকৃত গুরু হতে পারেন যখন সে তার ছাত্রদের জীবনে আনতে পারে চরিত্রের উৎকর্ষতা।আর এই দিক দিয়ে জি .বালু সত্যিই সফল।