আবার সংবাদপত্রের হেডলাইন হলেন এক আইএএস আফিসার। সেটা শুধুই ভালো কাজের জন্য নয়, বরং সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকার জন্য। রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা না ঝোঁকানোর জন্য।
‘যখন সব জায়গা থেকে চাপ আসে, তখনও সত্যের প্রতি অবিচল থাকা সহজ নয়…আমাদের হাতে কিছু নেই, এমন ভাবনা ঠিক নয়। একজন অফিসার এভাবে ভাবলে সাধারণ মানুষের শক্তি বাড়ে।’ বলছেন শোরগোল ফেলে দেওয়া আইএএস অফিসার রোহিনী সিন্দুরি দাসারি।
আকস্মিক এবং অস্থায়ী বদলির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন রোহিনী। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং সত্যি কথা বলেছেন নির্ভিকভাবে।
রোহিনী সিন্দুরি সম্পর্কে কিছু কথা
ক) ১৯৮৪ সালের ৩০ মে অন্ধ্রপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এই ৩৩ বছর বয়সী আইএএস অফিসার।
খ) হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক।
গ) ইউপিএসসি পরীক্ষায় র্যাঙ্ক ছিল ৪৩। ২০০৯ সালের আইএএস ব্যাচ রোহিণী।
ঘ) ২৯ আগস্ট ২০১১ থেকে ৩১ আগস্ট ২০১২ পর্যন্ত তিনি তুমাকুর-র সহকারী কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ৩১ আগস্ট ২০১২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১২ পর্যন্ত সল্পমেয়াদের জন্য নগর উন্নয়ন বিভাগের কমিশনার হিসাবে স্থানান্তরিত হন।
ঙ) এরপর এক বছরের জন্য বেঙ্গালুরুর পল্লী উন্নয়ন এবং পঞ্চায়েতী রাজ বিভাগের স্ব কর্মস্থান প্রকল্পে নিযুক্ত হন।
চ) ২০১৪ সালের মে মাসে ম্যান্ডেলা জিলা পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাহী হিসাবে দায়িত্বভার পেয়ে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের হয়ে ব্যতিক্রমী কাজ করেন। তাঁর কাজে প্রভাবিত হয়ে সরকার তাঁকে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর/ ডেপুটি কমিশনারদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেন।
ছ) ২০১৫ সাল পর্যন্ত কর্ণাটক ফুড অ্যান্ড সিভিল সাপ্লাই কর্পোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার সামলান। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নিযুক্ত হন হাসান জেলার ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর হিসাবে।
রোহিণীর কর্মজীবন
ক) ম্যান্ডেলা জিলা পরিষদের সিইও হিসাবে, রোহিণী সফলভাবে ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে ১.০২ লক্ষ পরিবারে পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা করেন।
খ) সারা জেলায় ৮০, ০০০ শৌচাগার নির্মান করেছিলেন। যা রাজ্যে প্রথম এবং সারা দেশে তৃতীয় স্থান অধিকার করে।
গ) বাড়ি বাড়ি বিশুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ৬৫ কোটি টাকা অনুদান সফলভাবে ব্যবহার করেন রোহিণী। কেন্দ্র আরও ৬ কোটি টাকা অনুদান মঞ্জুর করে।
ঘ) ম্যান্ডেলাবাসীদের সাহায্য করার জন্য তাঁর জনপ্রিয় কৌশলগুলির মধ্যে একটি ছিল গ্রামবাসীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। গ্রামে ঘুরে ঘুরে শৌচাগার নির্মানের প্রয়োজনীয়তাগুলি বুঝিয়েছিলেন।
ঙ) রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।
চ) সৎ আইএএস অফিসারদের মতো তাঁর যাত্রাও সহজ ছিল না।
ছ) জেলা নির্বাচনি কর্মকর্তা হিসাবে পি.ডব্লিউডির পরিদর্শণে বেরিয়ে বেঙ্গালুরুর হাসান জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর অফিস এবং কার্যালয় সিল করে দেন।
ভোটের তারিখ ঘোষণা হওয়ার পরেও সরকারি সম্পত্তি ব্যবহার করে বিধি লঙ্ঘন করেছেন ওই মন্ত্রী। তাই তাঁর অফিস এবং কার্যালয় সিল করে দেন আইএএস অফিসার রোহিণী।
জ) বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার কারণেই তাঁকে বারবার বদলি করে দেওয়া হয়। তবে হাল ছাড়েননি রোহিণী। তিনি সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন।
বদলির বিরুদ্ধে লড়াই
হাসান জেলার ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দেওয়ার ৮ মাসের মধ্যেই তাঁকে বদলি করার জন্য রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কর্নাটক হাইকোর্ট এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের অনুরোধের পর তাঁর বদলি স্থগিত করা হয়েছে ৫ মার্চ পর্যন্ত। এই হস্তান্তর আদেশ পুনরায় জারি করতে অন্তত ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগবে।
‘বেঙ্গালুরু মিরর’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রোহিণী বলেছেন, ‘আমি খুব ভালো কাজ করছিলাম। এক বছর তিন মাস আর কয়েকদিনের কাজে কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। যখন তারা কিছুই খুঁজে পায় না তখন বলে, ‘গৌরভ কোটিলা’…এর অর্থ কী? আমরা এখানে জনগণের সমস্যা সমাধান করতে এসেছি। আমি শুধু ২ থেকে ৩ মাস বাড়তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি, যাতে আমার কাজ শেষ করে যেতে পারি। তারা জানতে চেয়েছিল, এখানে থাকার জন্য আমার আগ্রহ কেন।’ তাঁর কথায়, ‘যখন কোনও জায়গায় প্রশাসন স্থাপন করে টিম গড়ে কাজ শুরু হবে তখন বলবে সব ছেড়ে চলে যাও। এমন করার কোনও মানে নেই। আমি কাজ করতে চাই। আমায় কিছু করার সময় এবং জায়গা দেওয়া উচিৎ।’
অবশ্য রোহিণীর জায়গায় থাকলে বেশিরভাগ কর্মকর্তাই ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত থাকেন কিন্তু তিনি ধাঁচে গড়া। তাই রোহিণী সব বাধা হারিয়ে রাস্তায় নেমে জনসাধারণের জন্য কাজ শুরু করেন। ‘ব্যাঙ্গালোর মিরর’কে বলেছেন, ‘আইন আমাদের জনস্বার্থের কাজের জন্য নিয়োগ করেছে। সেই আইনকে সবার সম্মান করা উচিৎ। কেউ আইনের ওপরে নয়।’
আইএএস রোহিণী নারীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যিনি রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত না করে নিজের কাজ করে গেছেন সুষ্ঠ ভাবে।