তাঁর মৃত্যুর পর কেটে গেছে ৫২ বছর। কিন্তু এখনও তিনি সীমান্তে প্রহরায় অচল-অটল। কর্তব্যে ছেদ পড়েনি একটুও। সম্প্রতি তিনি অবসর নিয়েছেন। কিন্তু সেটা ওই খাতায় কলমে। কর্মে চ্যুত হন না তিনি। যে কোনও বাধা বিপত্তি প্রতিকুলতার সম্মুখীন হয়েও তিনি অমর যোদ্ধা হরভজন সিং। ‘হিরো অব নাথুলা’ নামেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে পরিচিত৷
তাঁর ভক্তের সংখ্যা অগণিত৷ তাঁরাই তাঁকে বাবা নামে সম্বোধন করেন৷ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, বিশেষ করে ভারতীয় সেনাদের বেশিরভাগই বিশ্বাস করেন তাঁর আত্মা প্রত্যেক সেনার রক্ষায় সদাসতর্ক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার কিলোমিটার ওপরে ভারত এবং চীনের সীমান্ত এলাকা নাথুলা। ঐতিহাসিক ‘সিল্ক রুট’ বলতে যে পথের কথা বলা হয়, সেই পথ ছিল নাথুলার পাশ দিয়ে। এখন নাথুলা পাস এবং সাইনো-ইন্ডিয়ান সীমান্ত। এখানেই ১৯৬৫-র সাইনো-ইন্ডিয়ান যুদ্ধে শহীদ হন হরভজন সিং। সাহসিকতা ও কাজের জন্য মরণোত্তর মহাবীর চক্র প্রদান করা হয় তাঁকে।
মাত্র ২২ বছর জীবিত ছিলেন হরভজন সিং৷ তাঁকে ঘিরে রয়েছে অজস্র লোকগাথা৷ ঘটনার শুরু ১৯৬৮ সালের ৪ অক্টোবর। প্রবল বর্ষার ফলে বন্যার মধ্যে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নিখোঁজ হন ভারতীয় সিপাহি হরভজন সিং। বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কিন্তু পরে ঘটে এক চমকপ্রদ ঘটনা। মৃত্যুর তিন দিন পর তাঁর দেহ পাওয়া যায়৷ কথিত আছে, হরভজন সিং উদ্ধারকারী দলকে নাকি সাহায্য করেন তাঁর দেহ খুঁজে বের করতে৷ শুধু তাই নয়, তাঁর এক সহকর্মীকে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করার জন্য নাকি স্বপ্নাদেশও দেন তিনি৷
প্রচলতি তথ্য মতে, ‘ওই এলাকায় কর্মরত এক সেনা জাওয়ান তার হারিয়ে যাওয়া সহকর্মী হরভজন সিংকে স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে সিং বলেন, ওই পাহাড়ি এলাকায় তার দেহ আটকে আছে। সেনাবাহিনীর একাধিক জওয়ান সেই একই স্বপ্ন দেখতে থাকেন। বাহিনীর পক্ষ থেকে একটি দল পাঠিয়ে স্বপ্নে দেখা জায়গায় খোঁজ করতেই পাওয়া যায় হরভজন সিংয়ের মরদেহ। সেই থেকে রহস্যের শুরু। স্থানীয় বাসিন্দা ও জওয়ানরা বিষয়টি ‘আলৌকিক’ ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন।
সহকর্মীদের স্বপ্নে হরভজন সিং দু’টি অনুরোধ করেছিলেন। এক, তার নামে যেন একটি সমাধি নির্মাণ করা হয়। দুই, মৃত্যুর পরেও একজন সেনা হিসেবে কাজ করে যেতে চান তিনি। সেই ইচ্ছা অনুযায়ী বৈঠকের সময় এখনও তাঁর জন্য একটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়।
কিছু ভারতীয় সেনা মনে করেন ইন্দো-চিন যুদ্ধের আগে বাবা ভারতীয় সেনাদের এই আসন্ন আক্রমনের বিষয়ে সতর্ক করেন৷ নাথুলার সেনাদের সংগ্রহ করা কিছু অর্থ প্রতিবছর বাবা হরভজনের মা কে পাঠানোর কথাও শোনা যায়৷ বাবার স্মৃতিসৌধে গেলে দেখতে পাবেন, একটি শয়নকক্ষের মতো কিছুটা, যেখানে সেনাদের পোষাক, জুতো, বিছানা, কম্বল সবকিছু রাখা আছে৷
শুধু তাই নয়, তাঁর জন্য নির্দিষ্ট একটি কার্যালয়ও রয়েছে৷ বাবাকে নিয়ে প্রচলিত বহু গাথা কান পাতলেই শোনা যায়। ভারত ও চীন সীমান্তে এক সেনা জাওয়ানকে একা ঘোড়ায় চড়ে পাহারা দিতে দেখেছেন দুই দেশেরই সীমান্ত রক্ষীরাই। তিনিই হরভজন সিং বলে মনে করা হয়। হরভজন সিংহের নিজের সামরিক উর্দি, জুতো সবই এখনও সযত্নে সংরক্ষিত। পরিপাটি করে রাখা আছে তাঁর ব্যবহৃত বিছানাও। কিন্তু নাথু লায় পাহারারত জওয়ানদের দাবি, মাঝে মাঝেই সেই পরিপাটি এলোমেলো হয়ে যায়। তাঁদের বিশ্বাস কাজের মাঝে হরভজন সিংহ নিজেই এসে বিশ্রাম নেন সেখানে।
‘তিনি’ যে ‘টহল’ দেন, সে প্রমাণ নাকি পাওয়া যায় তাঁর জুতোজোড়া থেকেও। সে দু’টিতে নাকি মাঝে মাঝেই ধুলোকাদা লেগে থাকে। অথচ তাঁর সামরিক উর্দির পরিচ্ছন্নতা একচুলও এ দিক ও দিক হয় না। কিংবদন্তি বলে, সিপাই হরভজন নিজেই তাঁর উর্দি পরিষ্কার রাখেন। মৃত্যুর পর সাম্মানিকভাবে ‘কর্নেল’ পদে উত্তরণ হয়েছে তাঁর। অবসরে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত তার বাড়িতে বেতনের চেক পৌঁছে দিত ভারতীয় সেনাবাহিনী। ওই মন্দিরে ভক্তরা প্রসাদ হিসেবে নিয়ে আসেন শুধু এক বোতল জল। ভক্তদের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানে খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে।
১২ বছর আগে পর্যন্ত প্রতি বছর নিজের বার্ষিক ছুটিও পেতেন বাবা হরভজন সিংহ। ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছত জিপ। সেখান থেকে ট্রেনে করে সেই জিনিস যেত পঞ্জাবের কপূরথালা জেলার কোকে গ্রামে। এ ভাবেই ‘ঘরের ছেলে’ ফিরে যেতেন ‘ঘরে’। আবার ছুটি ফুরিয়ে গেলে ফিরে যান কাজের জায়গায়। তবে তাঁর আর কাজের জায়গায় বদলি হয় না।
৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ‘কর্মরত’ নাথু লা-য়। হরভজন সিংহের নামে রিজার্ভেশন করা হত। ট্রেনের শূন্য বার্থে অন্য জওয়ানের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যেতেন ‘সিপাই হরভজন সিংহ’। সঙ্গে যেত তাঁর জিনিসপত্র। তবে ১২ বছর হল এই রীতি বন্ধ করা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে।
প্রতিবছর হাজার-হাজার মানুষ ১৪ হাজার ফুট দূরত্ব অতিক্রম করে এই মন্দিরে যান। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয় বাদ দিয়ে খুব নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ১৪ হাজার ফুট পাহাড়ের ওপর বরফে ঘেরা জমি আর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে হরভজন সিং এক লড়াকু মানুষের প্রতীক। যে লড়াকু মানসিকতা যেমন সীমান্তের প্রহরীদের সাহস যোগায়, ঠিক তেমনই সাহস যোগায় পৃথিবীর সব লড়াকু মানুষকে।