প্রাচীন কাল থেকেই ভারত জ্ঞান ,বিজ্ঞান, শিল্প,ধর্ম চর্চায় ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত উন্নত।আজকের বিশ্বে অনেক কিছুই নতুন নতুন আবিষ্কারের ঘটনা আমাদের সম্মুখে ঘটছে।তবে পুরাণ ও বেদের বিভিন্ন অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই সেইসব যুগেও মানুষ ছিল অত্যন্ত উন্নত।বিভিন্ন দেবদেবীর ক্ষমতা ও তাদের বিভিন্ন অস্ত্র,শস্ত্রের ব্যবহার আমাদের বারবার বিস্ময় করে।রামায়ন, মহাভারত, ও ভারতের চার বেদের বিভিন্ন ঘটনা যা আমরা সিনেমা, টিভিতে দেখি বা গল্পের বইয়ে পড়ি তা দেখে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে।এইসব পুস্পক রথ, বা সুদর্শন চক্র, বা অন্য আরও কিছু আমাদের অতীতের সেইসব পুরা কালের গৌরবের কথা তুলে ধরে।যদিও সেইসব তথ্যের সত্যতা কতটা তা কিন্তু আমরা জানি না।কিন্তু আজকের অনেক আবিষ্কারের সঙ্গে তাদের অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই।আমাদের মনে হয় ,অতীতের সেইসব জিনিস বর্তমানে নতুন রূপে পাচ্ছি।তবে আমরা হয়তো অনেকেই জানি না পুরাকালের ভারতের ঋষি, মুনিরা ও গনিতজ্ঞরা,জ্যোতির্বিদরা বর্তমানের অনেক আবিষ্কারের মূল ধারণা বহুকাল আগেই ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছেন বা বলে গিয়েছেন।আজ আমরা সেইরকমই ১০টি আবিষ্কারের বিষয়ে বলব যার সঙ্গে পুরাকালের ভারতীয়রা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত।
পরমানুর ধারণা
যদিও আমরা বিদ্যালয়ে পড়ার সময়, ভৌতবিজ্ঞান বই পড়ে জেনেছি ,পদার্থের ক্ষুদ্রতম কনার নাম পরমাণু।আর এই পরমাণু সম্পর্কে আমাদের প্রথম বৈজ্ঞানিক ধারণা দেন ইংরেজ পদার্থবিদ ও রসায়নবিদ জন ডালটন ।তিনি তার “পরমানুবাদ তত্বে”এই সম্পর্কে বিষদ মতামত দিয়েছেন।কিন্তু তার পরমাণু সম্পর্কে বলার ২৫০০ বছর আগেই এই সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিয়ে গিয়েছেন ভারতীয় দার্শনিক” মহর্ষি কনাদ”।তিনি পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার নাম পরমাণু দিয়েছিলেন।
শল্য চিকিৎসা(অঙ্গ প্রতিস্থাপন,মস্তিষ্ক চিকিৎসা অন্যান্য চিকিৎসা)
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমরা সহজেই দেখতে পাই ডাক্তারবাবুরা একজন মুমূর্ষু রোগীকে শল্য চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন।বর্তমানে চক্ষু, বৃক্ক, হৃৎপিন্ড ,ফুসফুস প্রতিস্থাপন আমরা করতে পারি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যবহারের ফলে।কিন্তু আজ থেকে বহু শতক আগেও এইসব উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে অনেক মানুষের প্রাণ বাচিয়েছেন প্রসিদ্ধ ভারতীয় আয়ুর্বেদিক ও চিকিৎসক সুশ্রুত।আমরা তার রচিত “সুশ্রুত সংহিতা” গ্রন্থ পড়ে জানতে পারি যে তিনি শল্য চিকিৎসায় ৩০০ এর বেশি বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতেন।তার শল্য চিকিৎসার জন্য ১২৫ টির বেশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন।তিনি বিভিন্ন জটিল অস্ত্রোপচার যেমন চোখের ছানি ,অঙ্গ প্রতিস্থাপন, কৃত্রিম রূপদান ইত্যাদি কাজে অত্যন্ত নিপুন ছিলেন।
আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি
বর্তমানে হোমিওপ্যাথিক ,এলোপ্যাথিক পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয় ।এই আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি কিন্তু আজকের বিজ্ঞানের পদ্ধতি নয়।আমরা যদি প্রাচীন গ্রন্থ পড়ি তাহলে জানতে পারবো যে এই পদ্ধতি বহু শতকের পুরানো।প্রাচীনকালের ভারতীয় আয়ুর্বেদিক “চরক”কে আয়ুর্বেদিক ওষুধের জনক বলা হয়।তিনি তার” চরক সংহিতা”গ্রন্থে ১০০০০এর বেশি ভেষজ উদ্ভিদের বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন।তাই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় মূল অবদান তারই।
পৃথিবীর ঘূর্ণন ও গ্রহণের সময়কাল
যদিও আমরা ভূগোল বই পড়ে বলতে পারি যে পৃথিবীর বা গ্রহদের ঘূর্ণন নিয়ে মতবাদ দিয়েছেন গ্যালিলিও বা কোপার্নিকাস ।কিন্তু প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গানিতজ্ঞ আর্যভট্ট সর্বপ্রথম পৃথিবীর ঘূর্ণনের সময়কাল নির্ণয় করেছিলেন গাণিতিক উপায়ে।এছাড়াও তিনি গ্রহণের নির্ভুল সময়কাল নির্ণয় করেন।তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বলেন পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
পৃথিবীর সূর্যের প্রদক্ষিণকাল
যদিও আমরা আধুনিক বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস ,গ্যালিলিও প্রভৃতির জ্যোতির্বিদ ও বৈজ্ঞানিকের মাধ্যমে তথা আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে জেনেছি পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড।কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় ভারতীয় জ্যোতির্বিদ ভাস্করাচার্য আজ থেকে ২০০০ বছর আগেই পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণকাল নির্ণয় করেছিলেন।তিনি তার রচিত”সিদ্ধান্ত শিরোমণি “গ্রন্থে গ্রহদের বিভিন্ন অবস্থান, গ্রহণের সময়কাল সম্বন্ধে বিস্তৃত বিষয় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
শুন্যের ধারণা
ভারতীয় গানিতজ্ঞ আর্যভট্ট সর্বপ্রথম সংখ্যার ব্যবহারে শুন্য সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন।এবং তিনি শুন্যের বিভিন্ন ব্যবহার দেখিয়েছেন।পরে ভারত থেকেই তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।যদিও বর্তমানে এই সম্বন্ধে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
চন্দ্রের কিরণ
যদিও আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতি ও টেলিস্কোপ ব্যবহারের ফলে জানতে পেরেছি যে চাঁদের নিজের কোনো কিরণ থাকে না ।তা সূর্যের কিরণেরই প্রতিফলিত রূপ ।কিন্তু ভারতীয় জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির তার রচিত,”পঞ্চ সিদ্ধান্ত”গ্রন্থে এই সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।এছাড়াও বিভিন্ন গ্রহদের যে নিজের কোনো আলো নেই, সবই যে সূর্যের আলোয় আলোকিত তা তিনি বলেছেন তার গ্রন্থে।
চিহ্নের ধারণা
বিভিন্ন গাণিতিক চিহ্নের যেমন যোগ, বিয়োগ, গুন ও ভাগের সম্পর্কে সহজ করে ধারণা দেন ভারতীয় গানিতজ্ঞ আর্যভট্ট।এছাড়াও অজানা বিষয়কে নির্ণয় করতেও তিনি একটি নির্দিষ্ট অভেদের ব্যবহারের প্রচলন করেন।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি
আইজক নিউটনের আপেল থেকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সম্পর্কে ধারনা দেওয়ার বহু শতক আগেই এক ভারতীয় জ্যোতির্বিদ ও গানিতজ্ঞ এই সম্পর্কে ধারনা দিয়েছেন।তিনি হলেন ব্রাহ্মগুপ্ত।তার এই সম্পর্কে কাজের সূত্র ধরেই আরবের গানিতিকরা নয়ের দশকে ধারণা দেন পৃথিবী গোল এবং তা অন্যান্য অনেক কিছুকেই আকর্ষণ করে।
তাই আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বহু আগেই ভারতীয় বিজ্ঞান ও গাণিতিক ধারণা ছিল অনেক উন্নত ।এটা এককথায় স্বীকার করতে আর কোনো দ্বিধা রইল না।