শুধুমাত্র অটো চালিয়ে এনার মাসিক আয় লজ্জায় ফেলে দেবে কর্পোরেট সংস্থার কর্মীদেরও

নাম? আন্না দুরাই, বাসস্থান? চেন্নাই, শিক্ষাগত যোগ্যতা? দ্বাদশ শ্রেণি ফেল, পেশা? অটোচালক, বয়স? ৩৭ বছর। আপনার মনে নিশ্চই প্রশ্ন উঠছে, এ কার বায়োডাটা? উচ্চ মাধ্যমিক ফেল একজন সাধারণ অটোচালকে বায়োডাটা জেনে আমার কি লাভ? তবে শুনুন, এই সাধারণ অটোচালকই কিন্তু নিজেগুণে আজ অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সী একজন সাধারণ অটোচালকই যে একদিন সমস্ত বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাকে ম্যানেজমেন্ট শেখাবেন, ব্যাবসায়িক বুদ্ধি দেবেন, গ্রাহক কে কিভাবে খুশি রাখতে হয় তা শেখাবেন, এমনটা কি কেউ কখনও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন ?

   

চেন্নাইয়ের আর পাঁচটা সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের মতো একটি পরিবারেই বেড়ে উঠেছিলেন আন্না দুরাই। তার বাবা এবং দাদা, দুজনেরই পেশা অটোচালনা। তবে আন্না কিন্তু অটোচালকের পেশায় আসতে চাননি। তিনি ব্যবসায়ী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অভাবের সংসারে পরিবারের কথা ভেবে নিজের শখ এবং স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। আন্নাকেও ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে তাই অটোচালনাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে হয়েছিল।

তবে তিনি যে পেশাকে বেছেছিলেন, তাকেই তিনি নিজের মনের মতো গুছিয়ে নিয়েছিলেন। অটোযাত্রীরা তার গ্রাহক, আর তিনি এমন একজন ব্যবসায়ী যার প্রধান লক্ষ গ্রাহকদের খুশি রাখা! তাই তো তিনি অন্যান্য সকল অটোচালকদের থেকে আলাদা হয়ে উঠতে পেরেছেন। তার সঙ্গে সফরকালে যাত্রীরা নতুন কিছু শিখতে পারেন, নিজেদের সারাদিনের ক্লান্তি এবং অবসাদ ভুলে থাকতে পারেন ওই সফরকালীন সময়ে।

 The Amazing Anna - Inspiring Story Of An Auto Rickshaw Driver

কিভাবে? আন্নার কাজ শুধু যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া নয়। যাত্রী পরিষেবায় যাতে কোনও ত্রুটি না থেকে যায় তার জন্য তিনি নিজের পকেট থেকে উন্মুক্তহস্তে খরচ করেন। তার অটোতে উঠলেই খবরের কাগজ, দেশি-বিদেশি পত্রিকা, ওয়াই-ফাই,  ছোট টেলিভিশন এমনকি ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ব্যবহারের সুবিধাও পেয়ে যাবেন গ্রাহকরা! যাত্রাপথের শুরুতে প্রথম প্রথম তিনি নিজের অটোতে কেবল খবরের কাগজ রাখতেন।

এক যাত্রীকে একদিন ল্যাপটপের জন্য হাপিত্যেশ করতে দেখে আন্না নিজের অটোতেই তারপর থেকে ল্যাপটপ এবং ট্যাবলেট রাখতে শুরু করলেন। এরপর এক দম্পতিকে ইন্টারনেটের সমস্যায় ভুগতে দেখে আন্নার অটোতে এলো ওয়াইফাইয়ের সুবিধা।

Auto Anna

অভুক্ত যাত্রীদের জন্য ফল, স্নাক্স, ডাবের জলের পাশাপাশি স্কুল-ফেরত বাচ্চাদের জন্য চিপস এবং চকলেটও রাখতে শুরু করলেন আন্না। জানলে হয়তো অবাক হবেন, এই সব কিছুই তিনি গ্রাহকদের বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন!

প্রথাগত শিক্ষার দৌড়ে আন্না পিছিয়ে থাকলেও তিনি কিন্তু তার জ্ঞানের ভান্ডারকে সীমিত রাখেননি। ফিল্ম, খেলাধূলা, ফ্যাশন এমনকি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজের অবসরে চর্চা করেন তিনি। খবরের কাগজ থেকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কেও যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন তিনি।

Auto Anna

তাইতো সফরকালে যাত্রীদের সঙ্গে মজার আড্ডাও জুড়তে পারেন আন্না। সারাদিনের ক্লান্তি এবং অবসন্নতা নিয়ে যারা আন্নার অটোতে ওঠেন, তাদের কাছে রীতিমতো থেরাপির মতো কাজ করে এই সফর। আন্নার এই অটোতে বিনামূল্যে সফর করতে পারেন শিক্ষকেরা। তার মতে, ‘‘শিক্ষকেরাই তো চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, আইনজীবী বা সাংবাদিকদের গড়ে তোলেন। তাঁদের এ ভাবেই সম্মান জানাই আমি।’’ চেন্নাইয়ের হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির কথা সকলেই জানেন।

Auto Anna

অটো থেকে বেরিয়ে যাত্রীদের যাতে বৃষ্টিতে ভিজতে না হয় তার জন্য তাদের ছাতাও ভাড়া দেন আন্না। পরে যাত্রীরা সেই ছাতা আন্নার পরিচিত দোকানে রেখে যান। সেখান থেকেই তিনি ছাতাটি সংগ্রহ করে নেন। দিনে গড়ে ১০০ জন যাত্রীকে তিনি তার অটো পরিষেবা দেন। তার অটোতে সফর করার জন্য যাত্রীদের আগে স্লট বুক করতে হয়। এভাবেই প্রতিমাসে ১ লক্ষ টাকার কিছু বেশি উপার্জন করেন তিনি। যার থেকে একটি অংশ যাত্রীদের পরিষেবার পেছনে খরচ করেন আন্না।

 The Amazing Anna - Inspiring Story Of An Auto Rickshaw Driver

ব্যবসার ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্টের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পুরোনো গ্রাহককে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। তার জন্য আন্না তার অটোর নিত্যযাত্রীদের জন্য কুপনের ব্যবস্থা রেখেছেন! তার অটোর নিত্যযাত্রীরা এখন তার বন্ধুর মতো। যাত্রী সুবিধার্থে রোজ এত কিছু করেন যিনি, তার কথা প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১৩ সালে। একটি কর্পোরেট সংস্থা তার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে তাকে প্রথম ডেকে পাঠায়। এরপর থেকেই ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে নিজের মতাদর্শ রাখার জন্য হুন্ডাই, ভোডাফোন, রয়্যাল এনফিল্ড, টয়োটার মতো সংস্থাগুলির নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ওঠেন তিনি।

 The Amazing Anna - Inspiring Story Of An Auto Rickshaw Driver

আইআইটি, আইএসবি এমনকি ‘টেড এক্স টক’-এর তরফ থেকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাকে। সাংসদ শশী থারুর, বিজ্ঞাপন জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রহ্লাদ কক্কর থেকে মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেল্লার সঙ্গেও এক মঞ্চে বক্তৃতা রাখার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বড় বড় ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা তার কাছ থেকে ম্যানেজমেন্ট শিখবেন বলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। কর্পোরেট সংস্থা এবং ম্যানেজমেন্ট স্কুলগুলিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আন্না বরাবর গ্রাহকদের খুশি রাখার উপর জোর দেন। তার কাছে কোনও কাজই ছোট নয়।

পরিষেবার বিক্রি কতটা বাড়লো, সেই নিয়ে চিন্তা না করে বরং গ্রাহকদের সুবিধার্থে সঠিক পরিষেবা দেওয়ার উপরেই গুরুত্ব দেন আন্না। তিনি ব্যবসার এই মূল কথাটি বুঝে ফেলেছিলেন বলেই আজ সমগ্র চেন্নাই এমনকি চেন্নাইয়ের বাইরেও সকলেই তাকে এক বাক্যে “অটো আন্না” হিসেবে চিনেছেন।