এবার সরকারি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করলেই পেতে পারেন সোনার কয়েন

১২০ কোটির দেশ ভারতবর্ষ। আর এই দেশের এখনও প্রায় ৭০% এর মানুষের বাস গ্রামেই। এখনও পুরো দেশের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার মেরুদন্ড বলতে সরকার পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়। গ্রামেগঞ্জে  যদিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপর ভিত্তি করে শিশু শিক্ষার বিকাশ চলছে। শহারাঞ্চল ও শহরতলির দিকে কিন্তু অবস্থা সম্পূর্ন বিপরীত। আর এর কারণ হল ইংরাজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের প্রতি অভিভাবকদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া। যে সব বাবা মায়েরা সামর্থ আছে তারা আর তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চাইছেন না। তার চেয়ে তারা বেছে নিচ্ছেন বেসরকারি ইংরাজি মিডিয়াম স্কুল। যেখানে প্রতি মাসেই একটা মোটা টাকা ছাত্রদের জন্য তাদের খরচ করতে হচ্ছে। প্রতিবছর বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা গণ হারে কমছে শহর ও শহরতলির। আর তাই বাধ্য হয়ে স্কুলে ছাত্র ছাত্রী টানতে এবার ঠিক হয়েছে দেওয়া হবে সোনার কয়েন বা টাকা। শুনে অবাক হয়ে গেলেন? ভাবছেন এটা  কীভাবে সম্ভব ? পড়াশোনা করার জন্য এক পয়সা দিতে হবে না আবার পাওয়া যাবে সোনার কয়েন! কানে শুনে বা মুখে পড়ে বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে জেনে রাখুন এমনই ঘটনা ঘটেছে তামিলনাড়ুতে।

তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের কাছে আন্নুর অঞ্চলের কোনারপালয়ম গ্রামের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হবে তাদের মধ্যে প্রথম দশ জন পেতে পারে একটি করে ১ গ্রাম ওজনের সোনার কয়েন এবং ৫০০০ টাকা এবং তার সাথে দুই সেট স্কুলের পোশাক। আর এই সবই পাবেন বিনামূল্যে। এরজন্য আপনাকে কোন লটারিতে অংশগ্রহণ করতে হবে না। শুধু আপনার ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি করতে হবে ওই বিদ্যালয়ে। এমনই আজব ঘোষণা করেছে বিদ্যালয় কতৃপক্ষ।

কিন্তু কেন এইরূপ অভিনব উদ্যোগ নিতে হল স্কুল কতৃপক্ষকে? এই প্রশ্নের জবাব জানতে চাওয়া হলে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজেশ চন্দ্র কুমার ওয়াই জানান যে, “বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা যে হারে বছর বছর কমে যাচ্ছে, তাতে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করা না হলে এই বিদ্যালয় কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্রছাত্রীশুন্য হয়ে যেত। আর তাই আমরা বাধ্য হয়েই এই ব্যবস্থার শরণাপন্ন হয়েছি। ১৯৯৬সালে যখন এই বিদ্যালয় প্রথম এখানে খুলেছিল তখন বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৬৫ জন। আর তারপর বছর বছর এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা কমতে থাকে। প্রধানত এই অঞ্চলে ফসল উৎপাদনের পরিমান বছর বছর হ্রাস পাওয়ার জন্য বেশিরভাগ পরিবার কোনারপালয়ম গ্রাম থেকে পাশাপাশি দূরের অঞ্চলে চলে যেতে লাগে। আর তার ফলে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা খুবই কম হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে তা কমতে কমতে ১০ জনের মতো হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও এই অঞ্চলে ইংরাজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায়  বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের ওইসব বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে থাকে। আর তার ফলে আরও কিছু বছরে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা কমে ৫ হয়ে যায়।

ছবি : প্রতীকী

পাঁচ বছর আগে আমি যখন এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি তখন আমি মোটেই নতুন ছাত্রছাত্রী হিসাবে ৬ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করতে পেরেছি। বর্তমানে গ্রামে ৬৫টি পরিবার বাস করলেও এই বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়াতে পারি নি। আর তখন আমি এবং আমার সহকারী শিক্ষক ভানুমতী ঠিক করেছিলাম গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আর যখন আমরা গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করলাম, তখন আমরা এই সিদ্ধান্তে এলাম যে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা বাড়াতে হলে তাদের উৎসাহ বাড়াতে হবে। আর তাই তাদের নতুন কিছু দিতে হবে। সেই সময় গ্রামের একজন শিল্পপতি আমাদের জানালো যে তিনি নতুন যারা ভর্তি হবে এই বিদ্যালয়ে তাদের একটি করে সোনার কয়েন ১ গ্রাম ওজনের  দেবেন। এছাড়াও গ্রামের প্রধান সেলভরাজ জানান তিনি প্রত্যেক নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের ৫,০০০টাকা নগদ দেবেন।

ছবি : প্রতীকী

গ্রামবাসীরা এই অভিনব উদ্যোগে তাদের সম্মতি জানালে তা আমরা শিক্ষাদপ্তরে এইরকম প্রস্তাব  পাঠিয়ে  দিয়েছিলাম।শিক্ষা দপ্তর থেকে সম্মতি এলে আমরা কাজ শুরু করে দিয়ে থাকি।” কিন্তু এইভাবে বিদ্যালয় রেখেই কী লাভ?এমন জিজ্ঞাসা করা হলে, গ্রামের প্রধান সেলভরাজ জানান, “এটা আমাদের গ্রামের সম্মানের ব্যাপার। যেখানে তাদের পাশাপাশি সকল গ্রামের বিদ্যালয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে, সেখানে তাদের গ্রামের বিদ্যালয়ে যদি ছাত্রছাত্রী না পড়াশোনা করে তাহলে তা তাদেরই অসম্মান বোঝায়।তাই তারা এইরকম অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন।”

আর এই অভিনব উপায়ে খুব তাড়াতাড়ি কাজ হয়েছে তা বলা যায় । তিনজন নতুন ছাত্রছাত্রী এরই মধ্যে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।আরও তিনজন ভর্তি হতে চলেছে বলেই জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা ঠিক করেছেন ,বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রথম দশ জন ভর্তি হওয়া শিশুদের হাতে সোনার কয়েন, নগদ ৫,০০০টাকা তুলে দেবেন।

সত্যিই বিচিত্র দেশ ভারতবর্ষ।যেখানে ইংরাজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ঘরের টাকা পয়সা খরচ করে সবাই পড়ছে, সেখানেই সরকারি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি করার জন্য উপহারের টোপ দিতে হচ্ছে।