বিশ্বের সবচাইতে গরিব প্রেসিডেন্টের বিস্ময়কর জীবনযাত্রার গল্প

রাষ্ট্রপতি মানে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক। আগে-পিছে বডিগার্ড। বিলাসবহুল প্রাসাদ। হুটার বাজানো গাড়িতে যাতায়াত। কিন্তু লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মেলানো যাবে না কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে। তিনি নিজেই অনন্য। বিশ্বের সবচেয়ে গরিব রাষ্ট্রপ্রধানের তকমা পেয়েছেন উরুগুয়ের রাষ্ট্রপ্রধান হোসে মুজিকার।

প্রথাগত ঠাটবাটের বালাই নেই হোসে মুজিকারের। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর জন্য বিলাসবহুল প্রাসাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু ধূসর চুল, ছোট ছোট চোখ, কাঁচাপাকা পুরু গোঁফ, ভুড়িওলা হোসে স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন রাজধানী মন্টেভিডিও থেকে অনেকটা দূরের একটি খামার বাড়িতে। স্ত্রীর সঙ্গে ফুলের চাষ করেন। বাড়ির বাইরে কাপড় কাচার ঘর। সামনের মাঠে একটা কুয়ো। তার চারপাশ আগাছায় ভরা। প্রেসিডেন্টর এই বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন দু’জন পুলিশ। সঙ্গে পোষা কুকুর ম্যানুয়েলা। প্রিয় ১৯৮৭ ভি ডব্লিউ বিটল গাড়িটি সঙ্গে থাকে। প্রেসডিন্টকে দেশবাসী আদর করে ডাকেন ‘এল পেপে’ নামে।

উরুগুয়ের প্রেসিডেন্টের সম্পদের পরিমাণ এক হাজার ৮০০ ডলার। মাসিক আয়ের ৯০ শতাংশই দাতব্যে ব্যয় করেন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ উরুগুয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট দালিনো অ্যাস্ত্রোরির ঘোষিত সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ।

ষাট ও সত্তরের দশকে উরুগুয়ের গেরিলা সংগঠন তুপামারোসের সক্রিয় কর্মী ছিলেন হোসে মুজিকার। কিউবার বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে উরুগুয়ের বামপন্থীরা এই গেরিলা সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। গেরিলা জীবনে ছয়বার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। জেলে কেটেছে ১৪ বছর।  কঠোর শর্ত আর একাকিত্বের মধ্যেই বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরলে ১৯৮৫ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজের জীবনযাপনের ধারা বদলাতে রাজি নন হোসে মুজিকার। খামারবাড়ির বাগানের পুরোনো চেয়ারে বসে পোষা কুকুরকে আদর করে সময় কাটাতেই ভালোবাসেন মুজিকার। তাঁর কথায়, ‘আমি এভাবেই আমার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছি। আমার যা আছে, তাই নিয়ে আমি চলতে পারি। যারা শুধু ব্যয়বহুল জীবনযাপনের জন্য কাজ করে, সব সময় আরও বেশি বেশি চায়,  তারাই গরিব। অনেক বেশি বিত্তবৈভব না থাকলে সারাজীবন শুধু দাসের মতো কাজ করার কোনো দরকার নেই। বরং সময়টা নিজেকে দিন। আমাকে পাগল বা বুড়োর ভীমরতি মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই আমার পছন্দ।’

অনেক বছর একসঙ্গে থাকার পর ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট মুজিকা লুসিয়া তপোলান্সকি নামে একজন রাজনীতিবিদকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির কোনো ছেলেমেয়ে নেই। এই দম্পতির সবচেয়ে দামি সম্পত্তি হলো ১৯৮৭ সালে কেনা এক হাজার ৯০০ ডলারের একটি গাড়ি। তিনি নিয়মিত চলাচলের জন্য একটি অতি সাধারণ এই গাড়ি ব্যবহার করেন। ঘোরাফেরার জন্য তার নিত্যসঙ্গী ২৮ বছরের পুরনো ভোক্সওয়াগান বিটল। বর্তমানে এটি ভেঙে করুণ দশায় উপনীত হয়েছে। পুরাতন মডেল বলে খোদ নির্মাতা কোম্পানি ২০০৩ সাল থেকে এ গাড়ি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। মুজিকার গাড়িটি কিনতে চেয়েছিলেন এক আরব শেখ। তিনি গাড়িটির দাম হেঁকেছেন ৮ কোটি টাকা। কিন্তু মুজিকা রাজি হননি কারণ এ গাড়ির সঙ্গে তার বন্ধুত্বের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

তবে এমন সাধারণ জীবনযাপনের জন্য দেশের মানুষ তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও সরকারের ভুল কাজের সমালোচনা করতে পিছপা হননি কোনও দিন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় বিরোধীরা মুজিকার সমালোচনায় মুখর ছিলেন। জনপ্রিয়তা রেটিং নিয়ে তেমন চিন্তিত কোনও দিনই ছিলেন না মুজিকা। এখন ৭৭ বছর বয়সে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে যাবার সময় তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে বিনীত লোকটি আজ পদত্যাগ করলেন।