‘কেকে আমার শত্রু, ওর গান আমার দু’চোখের বিষ’, বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

সদ্য প্রয়াত হয়েছেন ভারতের প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কেকে (KK)। মাত্র কয়েক ঘণ্টার শারীরিক অসুস্থতার কারণে জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে পরলোক গমন করেছেন তিনি। কেকের মৃত্যুর পর তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নামিদামি সেলিব্রিটিরা পছন্দের গায়কের মৃত্যু প্রসঙ্গে শোক জ্ঞাপন করেছেন। কেকের মৃত্যু প্রসঙ্গে একটু অন্যরকমভাবেই বার্তা দিলেন কবি শ্রীজাত (Srijato)।

‘হাম রহে ইয়া না রহে কাল’ গায়কের মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকোস্তব্ধ গোটা ভারতবর্ষ। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধুই তার স্মৃতি। তারই মাঝে নজর কাড়লো কবি, গীতিকার এবং পরিচালকের ফেসবুক পোস্ট। সেখানে শ্রীজাত জানিয়েছেন বিগত ১৬ বছর ধরে তিনি কেকের গান শোনেন না। কেকের গান তার কাছে ‘অসহ্য’ লাগে! কেকে-কে কার্যত নিজের শত্রু বানিয়ে নিয়েছেন শ্রীজাত। কিন্তু কেন এমন মন্তব্য করলেন তিনি? কারণটাও উল্লেখ করে দিয়েছেন ফেসবুকের ওই পোস্টে।

Srijato

শ্রীজাত লিখেছেন, “KK-র গান আমার অসহ্য লাগে। গত ১৬ বছর ধরে অসহ্য লাগে। সেই ২০০৬-এর ডিসেম্বর থেকে আজ অবধি KK-র গান আমি সহ্য করতে পারি না। ক্যাব-এর রেডিও-তে হঠাৎ বেজে উঠলে চালককে তৎক্ষণাৎ বলি চ্যানেল সরিয়ে দিতে, কোনও জমায়েতে হুট করে বেজে উঠলে সন্তর্পণে উঠে বাইরে চলে যাই। এতটাই অসহনীয় আমার কাছে, KK-র গান, গত ১৬ বছর ধরে। টানা ১৬ বছর, আমি KK-র গান শুনিনি। সত্যি বলতে কী, পালিয়েছি তাঁর কাছ থেকে”!

আসলে তিনি কেকের থেকে পালাচ্ছেন না, তিনি পালাচ্ছেন তার ভাই পুশকিনের স্মৃতি থেকে। তার ভাই কেকের অনেক বড় ভক্ত ছিলেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর ক্রমে কেকের গান যেন তার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। লেখকের কথায়, “ব্যক্তিগত ক্ষয়ের কথা, আন্তরিক ক্ষরণের কথা সমক্ষে তুলে ধরিনি কখনওই, জীবনের প্রতি সংকোচ আর স্মৃতির প্রতি সম্ভ্রম থেকেই। কিন্তু কিছু আকস্মিকতায় সেসব বাঁধ, সেসব আড়ালও হয়তো টুটে যায় সাময়িক ভাবে। ছোট ভাই, যার আদরের নাম পুশকিন, তার প্রিয় গায়ক ছিলেন KK। আর তার হাত ধরে আমারও। গিটারে তার হাত চলাফেরা করত চমৎকার, আর সুরে গলাও খেলত দিব্যি। তার পড়াশোনা আর পরীক্ষার চাপের ফাঁকে ফাঁকে আমি তাকে জোর করে বসাতাম, ‘গান শোনা দেখি দু’খানা’। এমন বললে সে দু;খানা গানই গেয়ে উঠত কেবল। ‘ইয়ারোঁ, দোস্তি বড়ি হি হসীন হ্যায়’, আর ‘হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল”।

KK Last Stage Performance

বাইক দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে গিয়েছে ভাইয়ের প্রাণ। তাই ভাইয়ের প্রিয় মানুষটিকেও এড়িয়ে চলতে শুরু করেন শ্রীজাত। তাই এতো রাগ, এত অভিমান পুষে রেখেছেন নিজের মনে। তিনি জানিয়েছেন, “সেই থেকে আমি KK-র অসামান্য সুরেলা আর টানটান দরাজ কণ্ঠ থেকে পালিয়ে বেড়াই, কোনো অনুষ্ঠানে তিনি মাইক হাতে নিলেই আমি উঠে চলে আসি, কখনও পিকনিকের দুপুরে তাঁর গান বাজানো হলে আমার বাড়ি যাবার তাড়া চলে আসে। কেউ জানে না, কিন্তু ১৬ বছর ধরে এই একজন মানুষের গানের কাছ থেকে পালাই আমি। পিঠ বাঁচিয়ে, মন বাঁচিয়ে, চোখ বাঁচিয়ে”।

তিনি আরও লিখেছেন, “KK আসছেন শুনেই নজরুল মঞ্চের কাছাকাছি দিয়ে যাতায়াতের পথ বাছিনি আজ। কে বলতে পারে, যদি ‘ইয়ারোঁ, দোস্তি…’-র এক কলিও কানে ঢুকে আসে? পালিয়েছি আজও। কেবল বুঝিনি, তাঁরও পালানোর মতলব আছে, পুশকিনের মতোই। রাগ ছিল লোকটার উপর খুব। কখনও দেখা হলে কেঁদেকেটে ঝগড়া করার ছিল অনেকখানি। জড়িয়ে ধরবারও লোভ ছিল খুব, অভিমানে, অসহায়তায়। সেসব গানের সঙ্গেই ভেসে গেল”।

সবশেষে তার সংযোজন, “হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’… গানের কথাকে একজীবনে এমন অসহ সত্যি করে দিয়ে চলে যাবার মতো মানুষ কমই আসেন পৃথিবীতে। KK তাঁদেরই একজন। ১৬ বছরের গভীর ক্ষতের উপর মলমের বদলে মশাল চেপে ধরলেন তিনি। এমনই মশাল, যার আগুনে দূরে কোথাও পুশকিনের গিটারটাও পুড়ে যাচ্ছে, একা একা…”।