খলনায়ক হয়ে অবিরাম কুড়িয়েছেন দর্শকের অভিশাপ, অবসাদে চরম পরিণতি হয় সৌমিত্র ব্যানার্জীর

৯০ এর দশকের বাংলা ছবি মানেই নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে পরিবার নির্ভর ছবি। আর সেই ছবিতে যারা বাড়তি মশলা যোগ করে সিনেমাকে টানটান উত্তেজনাময় করে তুলতেন, তারাই হলেন বড় পর্দার দাপুটে খলনায়ক (Villain)! টলিউড (Tollywood) হোক বা বলিউড, যে সিনেমার খলনায়ক যত বেশি দাপুটে, যত বেশি অত্যাচারী, দর্শক মহলে সেই সিনেমা ততবেশি হিট। ৯০ এর দশকে টলিউডের এমনই একজন নামকরা খলনায়ক ছিলেন সৌমিত্র ব্যানার্জি (Soumitra Bannerjee)।

ষড়যন্ত্রকারী, নায়ককে অপমান করা কিংবা নায়িকাকে বিয়ের জন্য জোর জুলুম করা খলনায়কের চরিত্রে তিনিই ছিলেন পরিচালকদের প্রথম পছন্দ। পর্দায় তাকে দেখলেই আজও দর্শক রীতিমতো তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। পর্দার সৌমিত্র এবং বাস্তবের সৌমিত্র যে আলাদা, এমনটাও তারা ভাবতে পারেন না। তাইতো প্রকাশ্যে রাস্তায় কখনও দেখলেই সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসতেন!

এমনটাই একবার হয়েছিল মেদিনীপুরের দাঁতনে, এক অনুষ্ঠান মঞ্চে। সেখানে অনুষ্ঠানের আয়োজক সংস্থার তরফ থেকে টলিউডের তাবড় তাবড় অভিনেতা এবং অভিনেত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমন্ত্রিতদের তালিকায় সৌমিত্রও ছিলেন। একের পর এক তারকা তখন মঞ্চে উঠছেন। সৌমিত্রও তাদের সঙ্গে মঞ্চে উঠতেই দর্শক মহলে শুরু হলো বেজায় বিতর্ক। দর্শকদের সাফ কথা, যিনি নায়কের ক্ষতি করেন, যার নজর সব সময় নায়িকাদের উপর থাকে, তাকে কোনমতেই বরদাস্ত করা হবে না এই অনুষ্ঠানে!

আপাতদৃষ্টিতে দর্শকের এমন আচরণ অপমানজনক মনে হলেও এই ছিল সৌমিত্রের প্রাপ্তি। পর্দায় তার অভিনয় এতটাই সাবলীল মনে হত যে দর্শক গুলিয়ে ফেলতেন কোনটা আসল এবং কোনটা অভিনয়! তবে অভিনেতা কিন্তু খলনায়ক হিসেবে নিজের এই সাফল্যে বিশেষ খুশি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন নায়ক হতে। তবে একের পর এক ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় তিনি এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন যে নায়ক হিসেবে তাকে মানানসই মনে হতো না।

পান্ডুয়ার দমদমা গ্রামে জন্ম হয়েছিল সৌমিত্রর। স্থানীয় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে তিনি তার পড়াশোনা সম্পন্ন করেছিলেন। অভিনয় ছাড়াও গানের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। মাত্র ৮ বছর বয়সেই তার ফিল্মি কেরিয়ারে শুরু হয়। ‘সুভা’ এবং ‘দেবতার গ্রাস’ নামের দুটি ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। এরপর অবশ্য পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। অভিনয় ছাড়লেও গান ছাড়েননি সৌমিত্র। গানের প্রতি আগ্রহ থেকে একটি বারে গায়ক হিসেবে কাজ নেন তিনি। প্রধানত কিশোরকুমারের গানগুলি তার কণ্ঠে অসাধারণ শোনাতো।

Soumitra-Banerjee

গানের পাশাপাশি যাত্রা-থিয়েটারেও কাজ করতে শুরু করেন তিনি। একইসঙ্গে টলিউড থেকেও ডাক পেতে থাকেন তিনি। প্রথমদিকে ছোটখাটো সাইড রোলে অভিনয় করতেন। তবে ১৯৮২ সালে দেবশ্রী রায় এবং মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘ত্রয়ী’ ছবিতে অভিনয় করার পর তার কেরিয়ারের মোড় ঘুরে যায়। এই ছবি সুপারহিট হওয়ার পর একসঙ্গে অনেকগুলি ছবির অফার আসতে শুরু করে তার কাছে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নায়কের তুলনায় খলনায়কের ভূমিকাতেই কাস্ট করা হচ্ছিল তাকে।

‘বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া ছেলে’র চরিত্রে তাকে ছাড়া আর কাউকেই যে বিশেষ মানাতো না! গুরুদক্ষিণা, মঙ্গলদীপ, আশা ভালোবাসা, অমর প্রেম, অনুতাপ, অঞ্জলি; সৌমিত্রের ঝুলিতে এমন অন্তত ১৫০ সফল ছবি রয়েছে। তবুও পছন্দমত চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ তাকে আজীবন তাড়া করে বেরিয়েছে। সেই আক্ষেপ থেকেই ক্রমশ মদের প্রতি তার আসক্তি বাড়তে থাকে।

অতিরিক্ত মাদকাসক্তিই যে তাকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, তা মোটেই টের পাননি তিনি। আর এভাবে চলতে চলতেই ২০০০ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সেই তার মৃত্যু হয়। যদিও তিনি আজ তার কাজের মাধ্যমে দর্শকমহলে বেঁচে রয়েছেন। আজও পর্দায় তাকে দেখলেই টানটান উত্তেজনা দর্শককে ঘিরে ধরে।