বয়স তখন ১২, ইচ্ছা না থাকা সত্বেও এক দিনমজুরের সাথে তার বিয়ে হয়৷ অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে মেনে নিতে হয় পরিবারের সিদ্ধান্ত। এক বছর পরেই প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। কয়েক বছর পরই জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান। অভাবের সংসারে শুধু একটু সুখ খুঁজেছিলেন সুভাসিনী দেবী ও তার স্বামী।
কিন্তু তাঁর কপালে সুখ সইলো না, কয়েক বছর পরেই স্বামীকে হারালেন সুভাসিনী দেবী। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিধবা হয়ে দুই সন্তান নিয়ে জীবনযুদ্ধে নামলেন।
স্বামীর মৃত্যুর সময় সুভাসিনী দেবী দিনে মাত্র ৫ পয়সা আয় করতেন। ঘরভাড়া বাবদ দুপয়সা, দুপয়সা যেত খাওয়াদাওয়া আর বাকি এক পয়সা জমাতেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে থালা-বাসন মেজে সংসার চালাতেন তিনি।
দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারছিলেন না বলে মেজ ছেলে অজয়কে অনাথ আশ্রমে দেন সুভাসিনী দেবী।পরবর্তীকালে সবজির ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
তবে একটি তাকাও খরচ করেননি তিনি। কারণ স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মনে মনে পণ করেছিলেন তাদের মতো গরীবরা যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যান তার জন্য একটা কিছু করবেন তিনি। এভাবেই তিল থেকে তাল করছেন তিনি।
এক সময় এক এক করে জমে যায় এক লাখ টাকা। সেই টাকায় হংসপুকুরে এক একর জমিও কিনে ফেলেন। বাড়ি করার জন্য নয়, হাসপাতাল করার জন্য। বড় ছেলে অজয় ততদিনে স্নাতক পাশ করেছেন।
তারপর সুভাসিনী অজয়কেই বললেন, ৪০ বছর ধরে লালন করে আসা স্বপ্নটির কথা। শুরু হলো ছোট্ট একটা কুড়ে ঘরে গরিব রোগীদের চিকিৎসা। তখন ১৯৯৩ সাল। ধান জমিতে মাথায় করে মাটি নিয়ে ফেলছেন।
তারপর আশপাশের মানুষ, গ্রাম প্রধান সবাই একসঙ্গে তৈরি করলেন ট্রাস্ট। স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি হল। সবাই টাকা দিল। প্রথমে তৈরি করা হয় আটচালা ঘর।
১৯৯৩ সালের সেই ছোট্ট কুঁড়ে ঘরটি আজ আয়তন এবং খ্যাতিতে অনেক বড়। তিন একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে সুভাসিনীর স্বপ্নের সেই হাসপাতাল। অজয়ের ডাক্তার বন্ধুরাও যোগ দিলেন বিনা পারিশ্রমিকে গরিবদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার কাজে। প্রথম দিনে বিনা খরচে তারা চিকিৎসা সেবা দেন ২৫২ জন মানুষকে।
১৯ কাঠা জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। ২০ জন চিকিৎসক, এর মধ্যে ৪ জন বেতন নেন, বাকিরা বিনা পয়সায় কাজ করেন। রয়েছে ৩২ জন নার্স। এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসায় গরিব রোগীদের এক টাকাও লাগে না। বিনা পয়সায় দেওয়া হয় ওষুধ। আজ অবশেষে সুভাসিনী দেবীর সেই স্বপ্ন পুরণ হয়েছে। দেখুন এই ভিডিওটি-
৩০ শয্যার আইসিসিইউ, ভেন্টিলেশন। আউটডোর ছাড়াও মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, আই, ইএনটি, ইউরোলজি, পেডিয়াট্রিক, ইউরোলজি-সহ একাধিক বিভাগ চলে এখানে। অস্ত্রোপচার হয়, রয়েছে সব রকম পরীক্ষা ব্যবস্থা। নাম ‘হিউম্যানিটি হসপিটাল’। তবে লোকমুখে পরিচিতি ‘বুড়িমার হাসপাতাল’ নামেই।
এখনো দুবেলা নিয়ম করে উনি হাসপাতালে যান। হাঁসি মুখে প্রত্যেকটি রোগির খবর নেন । ইচ্ছাশক্তির জোরে জীবনে যেকোনো অসম্ভব কাজ কে যে সম্ভব করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সুভাসিনী মিস্ত্রী এবং তাঁর এই ‘হিউম্যানিটি হসপিটাল’।
কীভাবে কম খরচে মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়া যায় তা পরীক্ষা করে দেখতে আধুনিক-কর্পোরেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। তার দাবি, ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় যে হয় তা আমি ওদের দেখাতে চাই। সুভাসিনী দেবীর জীবন সংগ্রামের কথা যদি আপনাকে অনুপ্রাণিত করে থাকে তাহলে এই পোস্টটি শেয়ার করুন।