উৎপত্তি চিনের উহান শহর থেকে। তারপর কয়েকমাসেই সারা বিশ্বে তাবাহি সৃষ্টি করেছে করোনা। অলক্ষ্য একটি ভাইরাস যে এতটা শক্তিশালী হতে পারে তা কেও ভাবতে পারেননি। মহামারির কবলে সারা বিশ্বে মৃত্যু মিছিল। এত জীবন নিয়েও শান্ত হয়নি করোনা। আবাল বৃদ্ধবনিতা কেও ছাড় পাচ্ছেন না। যত সময় যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যার পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক খুঁজতে গবেষনা চলছে তবে বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারছেন করোনা ধাঁধার থেকেও জটিল। এর উত্তর খুঁজে বের করা এত সহজ নয়। কিন্তু যেখানে বিজ্ঞান এত এগিয়ে গিয়েছে সেখানে একটি ছোট্ট ভাইরাসের প্রতিষেধক খুঁজে বের করা যাচ্ছে না কেন?
গবেষকেরা বলছেন প্রতিষেধক বের করা সহজ হতো যদি করোনার চরিত্রে স্থায়িত্ব থাকতো। উৎপত্তি থেকে এখনও পর্যন্ত করোনার উপসর্গের যেসব লক্ষন দেখা যাচ্ছে তাতে অবাক চিকিৎসকেরা। অনেক চিকিৎসক বলছেন, ‘আমরা জীবনে এমন কিছু দেখিনি।‘ ব্রিটেনের চিকিৎসকেরা করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছেন করোনা আসলেই হালকা বিষয় নয়। এই ভাইরাস আসলেই জটিল। কোভিড -১৯ ভাইরাস মানবদেহে কিভাবে আক্রমন করেন তাঁর বর্ননাও দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
১) ভাইরাল নিউমোনিয়ার থেকেও জটিলঃ লন্ডনের সেন্ট মেরি’জ হাসপাতালের কনস্যালট্যান্ট অধ্যাপক অ্যান্টনি গর্ডন বলেন, চিকিৎসকেরা ভেবেছিলেন এই ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে আক্রমনকারী ও নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী একটি ভাইরাস। তবে পরবর্তীতে ষ্পষ্ট হয়ে যায় যে ভাইরাসটি কেবলমাত্র স্বাসতন্ত্র নয় আরও অন্যান্য অঙ্গ আক্রমন করছে।
কোভিড আক্রান্ত হয়ে যারা সংকটজনক অবস্থায় চলে যান তাঁদের ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু হয়, আর শরীরে তীব্র প্রদাহ। রক্ত জমাট বাঁধার ফলে শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গগুলিও অক্ষম হয়ে যেতে শুরু করে। ফলে রোগীর জীবন সংশয় দেখা দেয়।
২) অক্সিজেনের ঘাটতিঃ চিকিৎসকেরা বলছেনমার্চ মাস জুড়ে যুক্তরাজ্যের হাসপাতালগুলিতে এমন রোগী আসছিলেন যাদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। তবে অবাক করা বিষয় বলছেন উত্তর লন্ডনের হুইটিংটন হাসপাতালের অধ্যাপক হিউ মন্টগোমারি। তিনি বলছেন, ‘মানুষের রক্তের হিমোগ্লোবিন কণিকা অক্সিজেন বহন করে। এমন অনেক কোভিড-১৯ পজেটিভ রোগী এসেছেন যাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৮০ শতাংশের নীচে নেমে যায়। অর্থাৎ অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় কিন্তু তা সত্বেও সেই রোগীরা অবশ্বাস্যভাবে অসুস্থবোধ করেননি।‘
এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ডাক্তার অ্যান্টনি গর্ডন। তিনি বলছেন, এই ঘটনার সাথে প্রদাহের সম্পর্ক থাকতে পারে। প্রদাহের প্রভাব হয়তো রক্তনালীতে পড়েছে। অক্সিজেন রক্তে মিশতে পারেনি অথচ ফুসফুসে তেমন প্রভাবও পড়েনি। কোভিড-১৯ একটি রহস্যময় ভাইরাসে পরিণত হচ্ছে যাকে আবিষ্কার করতে হলে গভীর গবেষনা প্রয়োজন।
৩) প্রদাহ ও রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়াঃ ডাক্তার হিউ মন্টগোমারি বলছেন, ফুসফুস ও রক্তনালীর প্রদাহ রোগীর দেহে অন্যরকম জটিলতা সৃষ্টি করছে। ২৫ শতাংশ গুরুতর রোগীদের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস অবিশ্বাস্যভাবে ঘন ও আঠালো রক্ত তৈরী করছে। ডাক্তার বেভারলি হান্ট বলছেন- প্রদাহের কারণে বিশেষত রোগীর পায়ে রক্ত জমাট বেধে যাচ্ছে ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে ‘ভেইন থ্রম্বোসিস’ ও সারা শরীর ঘুরে ফুসফুসে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছে। এমনকি এই জমা রক্ত হৃদপিন্ডে বাঁ মস্তিস্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছে ফলে রোগীর হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে।
ডাক্তার বেভারলি হান্ট আরও বলছেন, ‘ফাইব্রিনোজেন’ প্রোটিনের ফলে রক্ত জমাট বাঁধে। সাধারণত এক লিটার রক্তে এই ফাইব্রিনোজেনের পরিমাণ থাকে ২ থেকে ৪ গ্রাম। তবে কোভিড আক্রান্ত রোগীর শরীরে এক লিটার রক্তে ১০ থেকে ১৪ গ্রাম ফাইব্রিনোজেন পাওয়া গেছে। যা তাঁর ডাক্তারি জীবনের অন্যতম ঘটনা।
৪) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গ বিকল করে দেওয়াঃ ডাক্তার অ্যান্টনি গর্ডন বলছেন, মানবদেহের ‘সাইটোকিন’ নামে এক ধরনের অনু মূলত সংক্রমণ ঠেকানোর অংশ হিসেবে উৎপন্ন করে। কোভিড-১৯ শরীরে আক্রমন করলে বিপুল পরিমাণে সাইটোকিন শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এঁকে বলা হয় ‘সাইটোকিন ঝড়’ এর ফলে শরীরে আরও বেশি প্রদাহ হয়। ইমিউন সিস্টেমের রক্তে টি সেলের মাত্রা কমে যায় এবং অন্যান্য প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যেতে শুরু করে।
এছাড়াও ডাক্তার হিউ মন্টগোমারি বলছেন, দুই হাজারের বেশি কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসিউতে নিলে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ছে। অনেক রোগীদের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে ও রোগীরা উল্টোপাল্টা আচরণ করছে। এমনকি ভেন্টিলেটর খুলে নেওয়ার পরও অনেকের জ্ঞান ফিরছে না।