পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা গতকাল থেকে শুরু হয়েছে। তাই সারা বাংলা তথা ভারতের যেসব জায়গায় এবং বিশ্বে বাঙালিরা যেসব যেসব জায়গায় তাদের উপস্থিতি রেখেছেন সব জায়গায় মণ্ডপে মণ্ডপে মাতৃবন্দনায় মেতে উঠেছে তারা। দেবী দুর্গা একদিকে যেমন অসুর শক্তির বিনাশ করে সমগ্র পৃথিবীতে ও স্বর্গ রাজ্যে নিয়ে এসেছিলেন শান্তির বার্তা, তেমনি মাতৃ রূপে তার সাথে দেখা যায় লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং কার্তিক ও গণেশকে। অর্থাৎ তিনি মাতৃরূপে এবং শক্তি রূপে পূজিত হন আমাদের সকলের কাছে। তেমনি আমাদের রক্ত মাটির দূর্গা অর্থাৎ প্রত্যেক নারী তাদের কাজের মাধ্যমে সমাজে যেমন পূজিত হয়, তেমনি তাদের স্নেহ মায়া ও মমতা দ্বারা সন্তানদের মঙ্গল কামনায় সদা নিয়োজিত থাকে তাদের হৃদয়।
এমনিতে নারী-পুরুষের বিভাজন যুক্ত কাজ বর্তমানে প্রায় নাই বললেই চলে। নারী আজ তার সাম্রাজ্য সকল দিকে বিস্তার করেছে। সে যেমন যুদ্ধ জাহাজ চালাতে সক্ষম তেমনি কম্পিউটার স্ক্রিনে সফটওয়্যার ডিজাইন করাতেও তার দক্ষতা সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ নারী শুধু ঘর সামলাচ্ছে তা কিন্তু নয়। নারীর হাতে একটা পুরো রাজ্য বা দেশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। দেবী দুর্গার মতোই নারী তার বিস্তার দশ দিকে অর্থাৎ সর্বত্রই ছড়িয়ে দিয়েছে। তাই মাতৃ বন্দনা থেকে শুরু করে মাতৃ নির্মাণের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা দেখা যায়। আজকের প্রতিবেদনে আমরা এমনই এক নারীর কথা তুলে ধরবো তুলে ধরবো ,যিনি তার কাজের মাধ্যমে মা দুর্গার রূপ এবং অবয়ব ফুটিয়ে তোলেন । আসুন এমনই মায়ের বন্দনা করি তার কাজের প্রশংসার মাধ্যমে।
বাঙালিদের অন্যতম সেরা পূজা হলো দুর্গাপূজা।আর এই দূর্গা পূজার প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য স্থান করে আছে কুমারটুলি। এই কুমারটুলিতে প্রতিবছর কয়েক হাজারেরও বেশি দূর্গা প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। প্রধানত পুরুষরাই এই প্রতিমা নির্মাণের কাজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকে। যদিও বর্তমানে নারীদের প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখা গিয়েছে। সাধারণত প্রতিমা নির্মাণ এক শিল্পীর কাজ ,আর শিল্পীসত্তা ফুটিয়ে তুলতে নারী-পুরুষ উভয়ই সমতুল্য ক্ষমতা বহন করে। কিন্তু নারীকে যেহেতু তার সংসারের কাজ সামলাতে হয় তাই বেশিরভাগ নারী সময় পায় না তার শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটাতে। তাই প্রধানত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিল্পী সত্তা প্রকাশ করে পুরুষ। কিন্তু এমন কিছু ব্যতিক্রমী নারী থাকেন যারা তাদের শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটায় সংসার করা অবস্থাতেও অর্থাৎ সেই নারী যেমন একধারে সংসার করে তার গৃহের সকলকে মুখে তুলে দেন খাবার, তেমনি অন্যদিকে তার কাজের মাধ্যমে নিজস্ব শিল্পী সত্তার পরিচয় দেয় সকলের সামনে। এমনই একজন নারী হলেন চায়না পাল ।যিনি তাঁর হাতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন মা দুর্গার রূপ এবং অবয়ব, তেমনি অন্যদিকে তার সংসার চালানোর মাধ্যমে বাড়ির সকলের মুখে তুলে দেন খাবার।
কলকাতার বনমালী স্ট্রিটের কুমারটুলি পাড়ায় গেলে দেখা যাবে খুব কম সংখ্যক নারী আছে যারা মা দুর্গা প্রতিমা নির্মাণের কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুক্ত। এমনই একজন নারী হলেন চায়না পাল। কুমারটুলি শিল্পী সমিতির সচিব শ্রী রনজিত সরকারের মতে,” সমগ্র কুমারটুলিজুড়ে খুব কম সংখ্যক মেয়ে আছে, যারা প্রতিমা নির্মাণের কাজের সঙ্গে যুক্ত। হাতে গোনা যেসব যেসব মেয়ে আছে তাদের সংখ্যা বড়জোর দশ থেকে কুড়ির মধ্যেই হবে”।
চায়নার নিজের কথায় ,”সতেরো বছর থেকে আমি এই কাজের সাথে যুক্ত। আমার পূর্বপুরুষরা এবং বাবা বিগত সত্তর বছর ধরে এই কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন এই কাজ করার মত আর কেউ সামনে এগিয়ে আসেনি ।আমার দুই ভাই এবং তিন বোন। ভাইদের এই কাজ করার আগ্রহ ছিল না এবং বোনেদেরও এই কাজ করার সাহস আসেনি। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই যেহেতু বাবার সাথে মূর্তি গড়ার কাজ দেখেছিলাম, তাই বাবার এই অসুস্থতার সময় পারিবারিক এই কাজ করতে এগিয়ে আসি। যেহেতু পরিবারের অর্থ উপার্জনের কথা আমাকেই ভাবতে হয়েছিল ,সেজন্য আমাকে এই কাজে এগিয়ে আসতে হয়”।
যদিও প্রথমে চায়না সাফল্য অর্জন করেছিল তা কিন্তু নয়। তার বাবার যারা প্রতিমা গ্রাহক যারা ছিলেন তাদের অনেকেরই সন্দেহ ছিল এই মেয়ে কি তার বাবার পর্যায়ের প্রতিমা নির্মাণ করতে পারবে ?তার বাবা যেভাবে সূক্ষ্মতার সঙ্গে প্রতিমার সৌন্দর্য তুলে ধরত, তা কি এই মেয়ের পক্ষে সম্ভব হবে? এই সমস্ত প্রতিকূলতা ধীরে ধীরে কাটিয়ে তুলেছিল চায়না। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তার চেষ্টার মাধ্যমে সে আজ এক দক্ষ মৃৎশিল্পীতে পরিণত হয়েছে ।আজ চায়নার অধীনে ৮থেকে ৯জন কারিগর আছে যারা এই মূর্তি ও প্রতিমা নির্মাণের কাজ এর সাথে যুক্ত আছে। চায়না তাদের কারিগরদের কোন মজুরি দেওয়া শ্রমিকের মত ভাবেন না। তারা যে তার পরিবারেরই একটা অঙ্গ তা বোঝা যায় যখন চায়না তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। আর আজ তাই চায়নাকে অনেকেই রক্তমাংসের মা দুর্গার সাথে তুলনা করেন ।একদিকে চায়না যেমন তার পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য দক্ষতার সঙ্গে বহন করে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি সংসারকে দৃঢ়ভাবে আগলে রেখেছেন।
তবে চায়নার কাজের কিছু সাহসী পদক্ষেপের জন্য তা অনেক প্রথাগত শিল্পী তথা মানুষের কাছে সমালোচিত হয়েছেন ।গত দুই বছর আগে একবার তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা যখন ঠিক করেন তারাও মা দুর্গা প্রতিমার ধুমধাম করে পূজা অনুষ্ঠান করবে। তখন তারা কুমোরটুলিতে এসে প্রতিমার খোঁজ করতে আসেন এবং তাদের পছন্দের প্রতিমা নির্মাণ করতে অনুরোধ করেন মৃৎ শিল্পীদের। তারা চেয়েছিলেন তাদের মা দেবী দুর্গার অবয়ব হবে অর্ধনারীশ্বর প্রতিমা। কিন্তু তাদের এই দাবি অনেক শিল্পী রাজি হয়নি ।শেষে যখন তারা চায়নার কাছে এসে তাদের এই দাবির কথা জানায় তখন চায়না এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল ।যদিও অনেকেই চায়নার এই সম্মতিকে ভাল নজরে দেখেননি। চায়নার নিজের কথায় ,”প্রত্যেক মানুষেরই মা দূর্গাকে পূজা করার এবং আরাধনা করার অধিকার আছে। তাই যখন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা আমার কাছে তাদের পছন্দমতো মা দেবী দুর্গার প্রতিমা নির্মাণ করার কথা জানান ,তখন আমি এক কথাতেই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম।
আরও পড়ুন : সংসার চালাতে ভারতের প্রথম মহিলা কুলি গৃহবধূ কুলির কাজ করেন
আজ কুমারটুলি জুড়ে অনেক মহিলাকে প্রতিমা নির্মাণের কাজ এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকা দেখা গেলেও এই কাজে প্রথম মহিলাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার পেছনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল চায়না। তাই চায়নাকে দেবী দুর্গার এই আগমন এর তিথিতে জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কুর্নিশ জানাই চায়নার এই লড়াইকে। আগামী এক সপ্তাহ ধরে আমরা হয়তো মৃন্ময়ী মা দুর্গার আরাধনায় মেতে উঠবো, কিন্তু রক্তমাংসের এইসব দুর্গা যারা তাদের কাজের মাধ্যমে নিয়ে এসেছে নব চেতনার স্রোত, তারা কি পাবে না তাদের যোগ্য সম্মান?