‘আমি বাংলায় কথা কই/ বাংলার কথা কই/ বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই/ আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে/ করি বাংলায় হাহাকার/ আমি সব দেখেশুনে ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার’।
এই বাংলা ভাষা তাঁর রক্তে। ভাষার জন্য শহীদ হওয়া দেশের পরম্পরা তিনি বয়ে চলেছেন। তাই ভাষার জন্য কটূক্তি শুনেও তিনি পিছু হটেননি একচুল।
কম্পিউটার কি ইংরাজি ছাড়া কোনও ভাষা বুঝতে পারবে? এই দোলাচলে ভুগছিলেন অনেক বাঙালিই। ভাবনা থেকে বাঙালিকে মুক্ত করেছিল – অভ্র। কিবোর্ডে একটু চাপেই কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে মুক্তাক্ষর – অ, আ, ক, খ.আহা! দেখে কী আরাম, কী স্বস্তি! ডিজিটাল যুগে দিকে দিকে বাংলা হরফ ছড়িয়ে দিতে ডাক্তার ছাত্র মেহেদি হাসান খান তৈরি করেছেন সফটওয়্যার – অভ্র।
বাংলাদেশের ছেলে মেহেদি হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারির ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকরা বলেছিলেন , মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দেওয়া উচিত মেহেদীর। কারণ ডাক্তারির পড়াশুনা বাদ দিয়ে, দিন-রাত এক করে, খাওয়া-ঘুম ভুলে হস্টেলের ঘরেই একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে মেহেদী তখন লড়ছিলেন বাংলা ভাষার জন্য লড়াই।
কম্পিউটারে বাংলা লেখার খুব অসুবিধা। তাই তিনি এমন একটা উপায় বের করতে চেয়েছেন, যাতে কিবোর্ডে ইংরাজি অক্ষরগুলোই সাজিয়েগুছিয়ে একটি জ্বলজ্বলে বাংলা শব্দ তৈরি করবে। সেইমতো সফটওয়ার তৈরির কাজে হাত দেন। সেসময় আশেপাশের মানুষজন মেহেদির এই ‘খ্যাপামি’ দেখে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। মেডিক্যাল কলেজ থেকেই বলা হচ্ছিল – ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিতে। কিন্তু এসবে কর্ণপাতও করেননি প্রতিভাবান আবিষ্কারমুখী তরুণটি।
তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রম, গবেষণার ফল আমরা পেয়েছি। সাধারণ মানুষ থেকে অফিসের কর্মী, আধিকারিক সকলেই স্বচ্ছন্দ্য অভ্রর মাধ্যমে কাজ করতে। শুধু সফটওয়ার উপহার দিয়েই থেমে থাকেননি মেহেদি। তৈরি করেছেন ক্যাচলাইন – ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা এটাই, যে কোনও সফটওয়ারই এই অভ্র বুঝতে সক্ষম। তাই এর গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তাও সর্বাধিক।
২৬ মার্চ,২০০৩ সাল, মেহেদীর জীবনে শুধু নয়, লক্ষ লক্ষ বাঙালির জীবনের একটি বিশেষ দিন। সেই দিন মেহেদী বিশ্বের সামনে আনলেন ‘অভ্র’ সফটওয়ার। যা আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের সব চেয়ে পছন্দের বাংলা রাইটিং সফটওয়ার। আজ বাঙালির কম্পিউটার, ল্যাপটপ খুললেই স্ক্রিনে একটি স্লোগান ভেসে ওঠে , ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’। এটিই ডাক্তার মেহেদী হাসান খানের তৈরি করা স্লোগান। তাঁর স্বপ্ন ছিল, ভাষাকে উন্মুক্ত করতে হবে সবার জন্য, বেঁধে রাখা যাবে না জটিলতার নাগপাশে।
অভ্রর দৌলতে আজ সুদূর তানজানিয়া থেকে রাশিয়া, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসে বাঙালি তার প্রিয় মানুষকে মনের কথা জানাতে পারেন খাঁটি বাংলা ভাষায় লিখে। ভাষার দূরত্ব মুছে দিয়েছেন মেহেদি হাসান খান। আর হ্যাঁ, ডাক্তারিও পাশ করেছেন সসম্মানে। জব্বর, বরকতরা বাংলায় কথা বলার জন্য লড়েছিলেন। আর মেহেদি ডিজিটাল বাঙালির হাতে লিপি জুগিয়েছেন। নীরব ইতিহাসের সাক্ষী থেকে এই কৃতিত্ব একা তাঁর।
মেহেদীর এই আবিষ্কারের ফলে কোটি-কোটি টাকা বেঁচেছে সরকারের। সমস্ত সরকারি দপ্তরগুলোতে ব্যবহৃত হয় ‘অভ্র’। লেখা হচ্ছে সরকারি ফাইলে, তৈরি হচ্ছে আমাদের পরিচয়পত্র। আর এত সবের মাঝে সরকার কিন্তু ভুলেই গিয়েছে ‘অভ্র’র জনকের কথা। কারণ? ছেলেটা যে কিছুই চায়নি তার এই আবিষ্কারের পরিবর্তে। না অর্থ, না পরিচিতি। চিরকাল প্রচারবিমুখ, বিনয়ী ছেলেটা তাই এত বড় একটা কাজ করেও রয়ে গেল প্রচারের আলোর বাইরেই। পেল না কোনও সরকারি স্বীকৃতি বা পুরস্কারও।