বলিউডের (Bollywood) এভারগ্রীন ট্রাজেডি কিং, ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমার (Dilip Kumar) আজও সিনে অনুরাগীদের মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছেন। ৯৮ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনের পথে পথ চলা আজ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল তার হৃদস্পন্দন। তবে দীর্ঘ ৭ দশক ধরে বলিউডে তার কাজের মাধ্যমেই তিনি আজীবন দর্শকের মন জুড়ে রাজার মতোই থাকবেন। দর্শকের মনে তার স্থানচ্যুতি হবে না।
বলিউডের এই কিংবদন্তি শিল্পী জন্মগ্রহণ করেছিলেন অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে। তার বাবা ছিলেন পেশোয়ারের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু তিনি কখনোই তার বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে চাননি। চিরকালের একরোখা ছেলেটির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাবার মতভেদ চলতেই থাকতো। একদিন এই বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে বাবার উপর রাগের বশে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ইউসুফ। যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন কিন্তু ইউসুফ খান দিলীপ কুমার হয়ে উঠতে পারেননি।
তখন নাসিকের বার্নেস বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন কিশোর ইউসুফ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুনের এক ক্যাফে মালিকের সঙ্গে আলাপ হয় তার। সেখানে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দম্পতির সহায়তায় এক ক্যান্টিন কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে আলাপ হয় ইউসুফের। সেনাবাহিনীর ক্লাবের কাছে একটি স্যান্ডউইচের দোকান খুলে ফেলেন তিনি। ইংরেজি বলা এবং লেখায় দক্ষতা থাকাতে ব্যবসা দাঁড় করাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি তাকে।
কিশোর অবস্থায় ব্যবসা শুরু করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ৫ হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেন তিনি। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য যখন প্রয়াস চালাচ্ছেন তিনি, তখনই তার এলাকার জনৈক মাসানির সঙ্গে। সেই মাসানির হাত ধরেই বোম্বে টকিজে পৌঁছে ইউসুফ। অভিনেত্রী দেবিকা রানির নজরে পড়ে যান তিনি। তার কাছে প্রস্তাব আসে সিনেমাতে অভিনয় করার। ১৯৪৪ সালে অমিয় চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘জোয়ার ভাটা’ ছবিতে ইউসুফ দিলীপ কুমার পরিচয়ে প্রথম অভিনয় করেন।
এরপর অবশ্য তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬ দশকের দীর্ঘ কেরিয়ারে ৬৫টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মন জিতে নেওয়ার পাশাপাশি বলিউডের একাধিক অভিনেত্রীর মনও জিতে নেন তিনি। অভিনেত্রী কামিনি কৌশল থেকে শুরু করে মধুবালা, তৎকালীন সময়ে বলিউডে রাজত্ব করতেন যে সুন্দরীরা, তাদের মনে রাজত্ব করেছেন দিলীপ কুমার। তবে তার জীবনের প্রথমার্ধে কোনও প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কামিনি কৌশলের দাদা দিলীপ কুমারের সঙ্গে কামিনীর সম্পর্কের বিরুদ্ধে ছিলেন।
অন্যদিকে মধুবালার বাবার সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে মধুবালার সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনও সম্পর্কে জড়াননি দিলীপ কুমার। তবে তার বয়স যখন ৪৪, তখন বলিউডের সুন্দরী অভিনেত্রী সায়রা বানুর (Saira Banu) হাত ধরে তার জীবনে আবার বসন্ত এলো। অভিনেত্রী সায়রা বানু ১২ বছর বয়স থেকেই ইউসুফ খানের প্রেমে অন্ধ ছিলেন। অন্যদিকে নবাগতা সায়রার রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল বলিউড। তার রূপের খ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল দিলীপ কুমারের কানেও।
প্রথম পরিচয়েই সায়রার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন দিলীপ কুমার। তবে তার কাছে সায়রা ছিলেন ‘বাচ্চা মেয়ে’। দীর্ঘদিন যাবৎ সায়রার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন দিলীপ কুমার। তবে শেষমেষ সেই ‘বাচ্চা মেয়ে’র কাছেই ধরা দিতে হয় তাকে। সায়রার মা জানতেন তার মেয়ের মন জুড়ে রয়েছেন দিলীপ কুমার। তাই শেষমেষ তার প্রচেষ্টাতেই ১৯৬৬ সালে ৪৪ বছর বয়সী দিলীপ কুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় ২২ বছরের সায়রার। সেই সময় সায়রার কাছে দিনগুলি কেটেছে স্বপ্নের মতো।
তবে শীঘ্রই তার স্বপ্ন ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। বিয়ের পর সায়রা এবং দিলীপের সন্তান গর্ভাবস্থায় মারা যায়। এরপরেই দিলীপ কুমার এক পাকিস্তানি নাগরিক আসমার প্রেমে পড়েন এবং সায়রার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ১৯৮১ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তবে সেই সম্পর্কে অবশ্য ২ বছরও টেঁকেনি, নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার সায়রার কাছে ফিরে আসেন দিলীপ। এদিকে সায়রাও পুরনো কথা ভুলে দিলীপ কুমারকে আবার আপন করে নেন। তারপর থেকে বলিউডের এই এভারগ্রীন জুটি একসঙ্গেই ছিলেন।
দিলীপ কুমারের সঙ্গে সংসার করবেন বলে সায়রা নিজের অভিনয়ের কেরিয়ার থেকে সময়ের আগেই অবসর নিয়ে নেন। তিনি শুধুই তার মনের মানুষের সঙ্গে সংসার করতে চেয়েছিলেন। এযাবতকালীন স্বামীকে সব সময় আগলে আগলে রেখেছেন তিনি। বয়সের ফারাকটা তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সায়রার কাছে দিলীপ কুমার কোহিনুরের মতো। যার প্রেমে তিনি সারাজীবন আবদ্ধ। প্রেমের সম্পর্কের মর্যাদা আজীবন দিয়েছেন সায়রা। আজ সকাল ৭ টা নাগাদ মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে বলিউডের সেই ম্যাজিকাল লাভ স্টোরির ইতি হলো। দিলীপ কুমারের শেষ মুহূর্তেও তার পাশে ছিলেন তার সারা জীবনের সঙ্গী, সায়রা বানু।