ভারতে এখন আতঙ্কের আর এক নাম পঙ্গপাল। শুধুমাত্র ভারতে নয়, মিশর, ইজরায়েল, আফ্রিকার দেশগুলিতেও ঝোড়ো হাওয়ার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের দল আতঙ্ক তৈরি করে। তছনছ করে ক্ষেতের ফসল, শস্য দানা সব কিছু শেষ করে দেয়। তবে অন্যান্য কতগুলো দেশের মতো ভারতেও যদি পঙ্গপাল খাবার অভ্যাস থাকতো, তাহলে এতটা বিভীষিকা ছড়াতো না, কিন্তু পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে পঙ্গপাল ডেলিকেসি।
পোকা খাওয়ার অভ্যাসকে বলা হয় “এন্টোমোফ্যাগি” আর যাদের এই অভ্যাস রয়েছে তাদের বলা হয় “এন্টোমোফ্যাগাস”। আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড-সহ বিশ্বের নানা দেশের খাদ্যাভাসেই রয়েছে পোকা। কয়েকটা সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ৮০ শতাংশ মানুষই “এন্টোমোফ্যাগাস”। তাদের খাবারের তালিকায় রয়েছে হাজারেরও বেশি প্রজাতির পোকা। মজার কথা, মেক্সিকোতে পুষ্টিকর খাবার হিসেবে পোকার চল রয়েছে।
রুক্ষ আগ্নেয়গিরি ঘেরা কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের পূর্ব দিকে উত্তর কিভুর রাজধানী গোমার সিংহভাগ দরিদ্র সীমার নীচেই পড়ে। খাবার বলতে পোকাই ভরসা। বাজারে রীতিমতো মাছ মাংশর মতো করে সাজিয়ে চলে পোকার কেনাবেচা। তারমধ্যে রয়েছে ঝিঁঝিঁ, গঙ্গাফড়িং, মথের লার্ভা আরো অনেক কিছু। তবে সুস্বাদু পোকা হিসেবে পঙ্গপালের কদর অনেকটাই বেশি। প্রোটিন ও পুষ্টি, দুটোই মেলে এই পঙ্গপালের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছেন, পঙ্গপালের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে, প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ১৩ থেকে ২৮ গ্রাম। পঙ্গপালের লার্ভায় প্রতি ১০০ গ্রামে ১৪ থেকে ১৮ গ্রাম প্রোটিন থাকে। পঙ্গপালের প্রতি ১০০ গ্রামে ফ্যাট রয়েছে ১১.৫ গ্রাম, কোলেস্টেরল ২৮৬ মিলিগ্রাম। তাছাড়া ফ্যাটি অ্যাসিডও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।
আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানারকমের পোকা, তার মধ্যে পঙ্গপালও রয়েছে। সৌদি আরবে আবার রমজানের সময় পঙ্গপাল রান্না করে খাওয়া হয়। এটা নাকি তাদের রীতির মধ্যেই পড়ে, আর সেই রীতি এখনও বজায় আছে। ইয়েমেনিরা আবার দিব্যি পঙ্গপাল রেঁধে খেয়ে চলেছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও।
পঙ্গপাল রান্নার বিশেষ রেসিপিও রয়েছে মরক্কোতে। মিশর, মরক্কো, আরবের বাজারে ভালো দামেই চলে পঙ্গপালের ব্যাবসা। তবে এই পঙ্গপাল খাওয়ার অভ্যাসটা বা রীতিনীতি গুলো ঠিক কবে থেকে এসেছে, তা বলা মুশকিল। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে জানান, প্রাচীনকাল থেকেই পোকা খাওয়ার অভ্যাস গুলো তৈরি হয়েছে, যার কিছুটা প্রয়োজনে, আর বাকিটা কোনও স্থানীয় রীতি – রেওয়াজের মাধ্যমে। বাইবেলের মধ্যেও মধু দিয়ে পঙ্গপাল খাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।
এই পঙ্গপালের আবার অনেক প্রজাতি আছে। তার মধ্যে চেনা পরিচিত প্রজাতি হল ডিজার্ট লোকাস্ট, যা উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রজাতির পঙ্গপাল মাইলের পর মাইল পথ উড়ে উড়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ায়। আবার আরেক ধরনের প্রজাতি রয়েছে, মাইগ্রেটরি লোকাস্ট বা পরিযায়ী পঙ্গপাল, এই প্রজাতির আবার কয়েকটি ছোট ছোট দল আছে। এদের এশিয়া আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডে দেখতে পাওয়া যায়।
‘ম্যাডিসন নেলসন ইনস্টিটিউট ফর এনভায়োরনমেন্টাল স্টাডিজ’ ও ‘ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন’ – এর গবেষকেরা জানিয়েছেন, কীট-পতঙ্গের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন সহ নানা পুষ্টিকর উপাদান। পাশাপাশি, এই পঙ্গপাল দিয়ে তৈরি কোনো রেসিপি খেলে শরীরে বাসা বাধা ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়াগুলো নষ্ট হয়ে যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
এই পোকার মধ্যে চিটিন নামে একপ্রকার ফাইবার রয়েছে যা সাধারণত ফল বা সব্জির ডায়েটারি ফাইবারের থেকে অনেকটাই পৃথক। এই ফাইবার শরীরের হজম শক্তি বাড়ায়। এটি অন্ত্রে সাহায্যকার ব্যকটিরিয়া “প্রোবায়োটিকস” তৈরিতেও সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গুলো জায়গায় ‘ইনসেক্ট ইটিং কালচার’ শুরু হয়েছে বর্তমানে। যেখানে পোকামাকড়ের তালিকায় পিঁপড়ের মত ছোট কীট থেকে শুরু করে রয়েছে পঙ্গপালও।