সঙ্গ দেয়নি শরীর, কবিতাকে হাতিয়ার করে জীবন যুদ্ধে জয়ী আবৃত্তিকার দেবস্মিতা

সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায় দুর্গাপুরের (Durgapur) দেবস্মিতা নাথের (Debasmita Nath) জীবনের গল্প। সিনেমার পর্দায় প্রতিবন্ধী শিশুদের সফল হওয়ার কাহিনী অনেক‌ দেখানো হয়। বাস্তবে তার জলজ্যান্ত নিদর্শন বর্ধমান জেলার ২০ বছরের তরুণী দেবস্মিতা। ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকস্তরের ইংরেজি অনার্সের ছাত্রী দেবস্মিতা হাঁটাচলা করতে পারে না। জন্ম থেকেই শারীরিক সমস্যাক কারণে বড় হয়ে ওঠার পথে নানা লাঞ্ছনা,প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মনের জোরে সে খুঁজে নিয়েছে সাফল্যের আলো।

২০১৯ সালে তাঁর আবৃত্তির সিডি সংকল প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা প্রেস ক্লাবে। নিয়মিত সমাজমাধ্যম ও ইউটিউবে প্রচুর লাইভ অনুষ্ঠানের দৌ‌লতে আবৃত্তিকার ও বাচিক শিল্পী হিসেবে দেবস্মিতা আজ একজন পরিচিত মুখ। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পুরস্করার ও সম্মান-স্বীকৃতি পেয়েছে সে। প্রতিবন্ধকতা হারিয়ে মনের জোরে আজ সফল আবৃত্তিকার দেবস্মিতা নাথ। তার জীবনের গল্পটা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে ২০ বছর আগে।

জন্ম ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল। আর পাঁচজন শিশুর মতো ছিল না সে। ছেলেবেলায় হামা দিতে পারতো না সে। মুখ দিয়ে ক্রমাগত ঝরত লালা। চার পাশে বালিশ দিয়ে বসিয়ে রাখতে হতো তাকে। চিকিৎসরা জানিয়ে দেন, দেবস্মিতার সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে হবে, নিয়মিত শোনাতে হবে গান ও কবিতা। দেবস্মিতা কথা বলতে শেখে সাড়ে তিন বছর বয়সে। বাড়িতে আঁকার শিক্ষক রেখে ছবি আঁকা শেখানো, লেখা শেখানোর পাশাপাশি, শেখানো হতো ছড়া। মা সুনীতা দেবী দেবস্মিতাকে ছবি আঁকানো, লেখা শেখানোর পাশাপাশি ছড়া শেখানোর ব্যবস্থা করেন। সবকিছুর মধ্যে ছড়া-কবিতার প্রতি তার আগ্রহ দেখা যায়। খুব তাড়াতাড়িই কবিতা মুখস্ত করে ফেলতে পারতো সে।

   

Life Story of Elocutionist Debasmita Nath

তবে শারীরিক সমস্যার জন্য নানা ভাবে কখনও সহপাঠী, কখনও শিক্ষিকাদের দ্বারা মানসিক নিগ্রহের শিকারও হতে হয়েছে দেবস্মিতাকে। বারে বারে বদলাতে হয়েছে স্কুল। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ের গুণ দেখার মানসিকতা আজও এই সমাজের নেই। তাই সহপাঠীদের থেকে শুরু করে শিক্ষিকাদের থেকেও নানাভাবে মানসিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে তাকে। বারবার স্কুল বদলেছে। তবে বদলাতে পারেনি কিছু জনের মানসিকতা।

দশম শ্রেণির আগে তিনটে স্কুল বদলাতে হয় তাকে। স্কুলে সবার করুণার পাত্রী হয়ে থাকা দেবস্মিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় সফল হয়ে নজর কাড়তে শুরু করে। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে আবৃত্তি করে দুর্গাপুরে ক্রমেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে দেবস্মিতা। সুযোগ মেলে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কবিতার ওয়ার্কশপে কবিতার তালিম নেওয়ার। তার আবৃত্তির বিশেষ ভঙ্গিমা আকর্ষণ করতে শুরু করে শ্রোতাদের।

১৭ বছর বয়সেই রবীন্দ্র সদন, বিড়লা অ্যাকাডেমির সভাঘর, শিশির মঞ্চ, ত্রিগুণাসেন মঞ্চ, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, বাংলা অ্যাকাডেমিসহ বিভিন্ন মঞ্চে আবৃত্তি উপস্থাপনা করেছে। ১৮ বছর বয়সেই পেয়েছে মনন সাহিত্য পত্রিকার সম্মাননা। ২০১৯ সালে তার আবৃত্তির সিডি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা প্রেস ক্লাবে। এছাড়া সমাজ মাধ্যমে ও ইউটিউবে নিয়মিত লাইভ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সে। আজ আবৃত্তিকার এবং বাচিকশিল্পী মহলের পরিচিত মুখ দেবস্মিতা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মনের জোরে সে আজ জীবনের জয়গান শোনাচ্ছেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে।