অধ্যাপনা ছেড়ে চিত্রনাট্য লেখিকা, লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন কাহিনী হার মানায় সিরিয়ালের গল্পকেও

সময়টা তখন আটের দশকের মাঝামাঝি। বাংলার সব ঘরে তখনও টেলিভিশন এসে পৌঁছায়নি। যাদের ঘরে টেলিভিশন এবং টেলিভিশনের সংযোগ ছিল, সেইরকম একটি পরিবারের মেয়েকেই আজকের এই প্রতিবেদনের নায়িকা বলা যেতে পারে। তবে সেই মেয়েটি কিন্তু দূরদর্শনের ধারাবাহিক দেখতে একেবারেই পছন্দ করত না। তাই মা-ঠাকুমা যখন ধারাবাহিক দেখতে বসতেন, সে তখন ধারাবাহিকের চ্যানেল বদলে সংবাদমাধ্যমের চ্যানেল ধরতো!

স্বভাবতই এই নিয়ে বাড়ির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্য, রাগারাগি লেগেই থাকতো তার! ধারাবাহিকের প্রতি এই বিরূপতার জন্য তাকে পরিবারের সদস্যদের থেকে কম তিরস্কৃত হতে হয়নি! কিন্তু তখন আর কে ভেবেছিলেন যে আজকে যার ধারাবাহিকের প্রতি এত বিরূপ মনোভাব, ভবিষ্যতে তাকে ছাড়া বাংলা টেলিমিডিয়া একপ্রকার অচল হয়ে পড়বে?

যার কথা বলছি তিনি বাংলার প্রখ্যাত লেখিকা, টেলিমিডিয়ার জনপ্রিয় পরিচালিকা ও প্রযোজক লীনা গঙ্গোপাধ্যায় (Leena Gangopadhyay)। বাংলা টেলি মিডিয়ার এই চিত্রনাট্য লেখিকাকে চেনেন না, সিনে অনুরাগীদের মধ্যে এমন আর কে আছেন? সারাবাংলা তার লেখনীর গুণমুগ্ধ। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল তার। ছোটবেলায় প্রথমে কমলা গার্লস স্কুল, তারপর সিস্টার নিবেদিতা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি।

এরপর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বাংলা বিষয় নিয়ে স্নাতক তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে একটি স্কুলে, তারপর কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি খুব ছোট বয়স থেকেই গল্প লেখার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন প্রথম গল্প লিখেছিলেন তিনি, তাও আবার প্রেমের গল্প!

তবে সেই গল্প অবশ্য প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু তার লেখাও থেমে থাকেনি। তৎকালীন সময়ে রেডিওতে সম্প্রচারিত গল্প দাদুর আসরে লেখা পাঠাতেন লীনা। এছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতে থাকেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সময় অবশ্য ধারাবাহিকের সঙ্গে তার দূরদূরান্তেও কোনও সম্পর্ক ছিল না। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি আর কলেজের অধ্যাপনা নিয়েই কাটছিল তার দিন।

এরমাঝে আচমকাই একদিন “সোনার হরিণ” ধারাবাহিকটির স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রযোজনা সংস্থা। প্রথমে এক মাসের জন্য ধারাবাহিকের স্ক্রিপ্ট লিখে দেওয়ার আবেদন জানানো হয় তাকে। তার লেখনীতে ধারাবাহিকটি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে পরবর্তী ১৩৫০টি পর্বের স্ক্রিপ্ট তাকেই লিখতে হয়েছিল! সেই থেকেই স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে টলিউডে তার কাজ শুরু হয়।

তিনি বরাবর স্বাধীনচেতা। টলিউডে অন্য কোনও প্রযোজনা সংস্থার হয়ে নয়, লীনা গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই নিজের প্রোডাকশন হাউস খুলে ফেললেন। নাম রাখলেন ম্যাজিক মোমেন্টস! বিগত প্রায় এক দশক ধরে টেলিমিডিয়ায় কার্যত ম্যাজিকই দেখিয়ে চলেছেন তিনি। তার লেখনীর জাদুতে “বিন্নি ধানের খই”, “কেয়া পাতার নৌকো”, “ইষ্টিকুটুম”, “জল নুপুর”, “পুন্যি পুকুর”, “ইচ্ছেনদী”, “ফাগুন বউ”, “নকশি কাঁথা” থেকে শুরু করে বর্তমানে “শ্রীময়ী”, “মোহর”, “খড়কুটো”র জন্য চিত্রনাট্য লিখছেন তিনি।

Leena Gangopadhyay

তিনি একই সময় একাধারে অনেক ধারাবাহিকের জন্য কাজ করতে পারেন! চিত্রনাট্যের পাশাপাশি সংলাপ রচয়িতাও তিনিই। প্রযোজনা এবং পরিচালনার ভারও রয়েছে তার কাঁধের উপর। তার লেখনী, চিত্রনাট্য এবং সংলাপ কার্যত দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। আধুনিক উন্নত শিক্ষিত সমাজ থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার মানুষেরাও তার রচিত চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন।

লীনা গঙ্গোপাধ্যায় তার কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের অদ্ভুত মিল ঘটাতে পারেন। আসলে বাস্তব থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি চরিত্রগুলিকে তার লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। তাই তার রচিত ধারাবাহিকগুলি দর্শকের থেকে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের পরিবর্তন ধরা পড়ে তার লেখনীতে। বর্তমানে তার ম্যাজিক মোমেন্টস প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করছেন শত শত মানুষ। তার ছেলে অর্ক গঙ্গোপাধ্যায় এবং পুত্রবধূ দেবলিনা মুখার্জিও তার সংস্থায় কর্মরত।