বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। এখানে আজও শতকরা ৩০ ভাগ মানুষ এক বেলা ভরপেট খেয়ে অন্যবেলা শুধু জল খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার এই দেশেই এমন কিছু মানুষ আছে যারা তাদের সম্পত্তি যদি প্রতিদিন কোটি টাকা হিসেবে খরচ করে তাহলেও হয়তো হয়তো ১০০বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে তবুও তাদের সম্পত্তি শেষ হবে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করার ক্ষমতা রাখলেও চরম আর্থসামাজিক বৈষম্য দেখা যায় আমাদের দেশেই। কিন্তু এখনে সাধারণ মানুষের দুঃখ ,কষ্ট এবং কর্মহীন জীবনকে নিয়ে আলোচনা করার সময় কার আছে? এখন যারা খ্যাতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন, যাদের আছে অঢেল ধন-সম্পদ, যারা পরিণত হয়েছেন ধনকুবের তাদের নিয়ে সবাই মেতে থাকতে চাই।
আজকের প্রতিবেদনে আমরা যে মানুষটির কথা আপনাদের কাছে জানাতে চলেছি তাকে নিয়ে হয়তো আমরা খুব একটা তথ্য আজ পর্যন্ত জেনে উঠতে পারিনি। কিন্তু এই মানুষটি বর্তমান ভারতের সেই সত্যকে সত্যকে তুলে ধরেছে যা হল, আপনার কাছে যদি, আপনার কাছে যদি ধন সম্পত্তি অসীম পরিমাণে থাকে তাহলে আপনি তা দিয়ে দিয়ে নিজের যাবতীয় সখ যেমন পূরণ করতে পারেন তেমনই এমন কিছু বিশেষ দ্রষ্টব্য জিনিস করতে পারেন যা সবার থেকে আপনাকে আলাদা রাখবে বা আপনাকে দেবে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার সুযোগ। কিন্তু ধর্মের জয় সর্বত্রই হয়, এই সত্যিটাও প্রকাশিত হবে। বলতে দ্বিধা নেই আজ যারা কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির অধিকারী তারা তাদের জীবনে কোন এক পর্যায়ে একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদের বর্তমানে স্থিতিতে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। কথায় বলে “টাকাতেই টাকা টানে”, আর এ কথা যে বাস্তবে বর্তমান সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে সত্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গলি জনার্ধন রেড্ডি(জি জে আর) যাকে ডাকা হত “বেল্লারি কিং” বলে। আদতে একজন খনি শিল্পপতি বা মাফিয়া হলেও তার ঐশ্বর্যপূর্ণ জীবনযাপন বারবার এসেছে সংবাদের শিরোনামে। যদিও তার জীবন সব সময় ঘটনার বৈচিত্র্যে ঘেরা তবে শেষবার তাকে নিয়ে সংবাদের শিরোনাম তৈরি হয়েছিল হয়েছিল ২০১৬ সালে, যখন তার একমাত্র মেয়ের বিবাহে খরচ হিসাবে শোনা গিয়েছিল এক বিরাট অঙ্কের টাকার পরিমান।
সূত্রের খবর অনুযায়ী সেই সময় তিনি তার একমাত্র মেয়ে ব্রাহ্মনীর বিবাহে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করেছিলেন। সেই বিবাহে উপস্থিত ছিলেন বলিউডের বিখ্যাত সেলিব্রিটিরা এবং তার সাথে টলিউডের অর্থাৎ দক্ষিণী সিনেমার বিখ্যাত বিখ্যাত তারকারা।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক নৃত্য ও সঙ্গীত শিল্পীরা সেই বিবাহে তাদের নৃত্য ও সঙ্গীত মঞ্চস্থ করেছিলেন এবং উপস্থিত অতিথিদের মনোরঞ্জন করেছিলেন। আর বিবাহের পোশাক তৈরি করতে শোনা যায় খরচ হয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। শুনে অবাক হয়ে গেলেন ? তাহলে এখনো আরো অনেক কিছুই বাকি আছে অবাক হওয়ার জন্য। আর তার জন্য পড়তে হবে বাকি অংশটুকু।
বর্তমানে তিনি আবার এসেছেন সংবাদের শিরোনামে। আর এবার তবে সম্পূর্ণ অন্য কারণে। প্রায় ৬০০ কোটি টাকার “আম্বিডেন্ট মার্কেটিং পঞ্জি স্কীম “সংক্রান্ত জালিয়াতির ঘটনায় ভারতীয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। আর তাকে নিয়ে যে অভিযোগ জমা পড়েছে তা নিয়ে তদন্ত এবং অনুসন্ধান চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। একজন সামান্য পুলিশ কনস্টেবলের ছেলে হয়ে কীভাবে তিনি এই বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক বা ধনকুবেরে পরিণত হলেন তারই কাহিনী বা বাস্তব ঘটনা আজ তুলে ধরব আমরা।
১৯৮৯ সালে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি একজন সামান্য ব্যবসায়ী হিসেবে। ২১ বছর বয়সে তিনি একটি কোম্পানি খোলেন “এন্যবেল ইন্ডিয়া সেভিং এবং ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড কোম্পানি” নামে। এই কোম্পানির ১২৫ টির মতো শাখা অফিস ছিল পুরো কর্ণাটক রাজ্য জুড়ে এবং বাৎসরিক সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন করেছিল। কিন্তু ২০০ কোটি টাকার ঋণ শোধ করতে না পারার জন্য কোম্পানি বন্ধ করতে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালে তিনি একটি খনি কোম্পানি খোলেন “ও এম পি সি” নামের। ২০০৩ সালে রাজ্যজুড়ে লোহার আকরিকের চাহিদা সাংঘাতিক হারে বেড়ে যাওয়ায়, আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একদম রকেটের বেগে উপরের দিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যায় তার ব্যবসা এবং ভাগ্য।
বিলাসবহুল “রেড্ডি ম্যানশন”
তিনতলা রেড্ডি ম্যানশন সকল রকম আধুনিক পরিষেবা সমৃদ্ধ।এই বাড়িতেই আছে একটি অফিস ঘর, একটি ইনডোর সুইমিং পুল, একটি ম্যাসাজ পার্লার, একটি বার, এমনকি বোমা বিস্ফোরণের আঘাত থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য এই বাড়িতে বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল “বোমার আঘাত প্রতিরোধী কক্ষ”। তার বাড়ি এবং বাড়ির চারপাশে আছে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বেষ্টনী। এছাড়াও বাড়ির চারপাশের ৫০০ মিটার পরিধি জুড়ে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা।
স্বর্ণ কুবের রেড্ডি
কথায় বলে মানুষের তাৎক্ষনিক উন্নতি যেমন নিয়ে আসে প্রভাব এবং প্রতিপত্তি, তেমনি তৈরি করে অহংকার, আর অহংকার থেকে শুরু হয় মানুষের অধঃপতন। তেমনই ২০১১সালে যখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তার বাসভবন “রেড্ডি ম্যানসনে “তল্লাশি চালায় আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি রাখার সন্দেহে। তখন তারা এক প্রকার অবাক হয়ে যান তার বাসভবনে সোনার ও বিভিন্ন অলঙ্কারের পরিমান দেখে।
সেই তল্লাশিতে বাসভবন থেকে উদ্ধার করা হয় সোনার থালা, বাটি, প্লেট এবং চামচ। তাছাড়াও ব্যাগভর্তি ৩ কোটি টাকা মূল্যের টাকা। এছাড়াও অলংকার হিসেবে যা পাওয়া যায় তা একপ্রকার অবাক করে দেওয়ার মত। ৬১০ টি সোনার ‘হাতের বালা’ যার মধ্যে ৪৫টিতে হীরের কাজ করা ছিল, ৪৫ টি সোনার নেকলেস, ৩০০ জোড়া ‘কানের দুল’ যার মধ্যে ৭৫টিতে হীরের কাজ করা ছিল,১২০০টি ‘কানের রিং’ যার মধ্যে ১০০টিতে হীরের কাজ করা ছিল এবং তাছাড়া অনেক মূল্যবান ধাতুর ব্রেসলেট ও মূল্যবান ধাতু প্লাটিনামের তৈরি অলংকার বাজেয়াপ্ত করেছিল তার বাড়ি থেকে। এছাড়াও ১৫ কেজি ওজনের সোনার মুকুট যার দাম ২.২কোটি টাকা তা বাজেয়াপ্ত করা হয় যাতে করা ছিল হিরের কাজ।
রেড্ডির গাড়ি প্রেম
তার গ্যারেজে থাকা গাড়িগুলি নিয়ে যা খবর পাওয়া যায় তা হল প্রত্যেকটি গাড়ি আন্তর্জাতিক মানের।যেমন বিলাসবহুল আধুনিক মডেলের রোলস রয়েস, রেঞ্জ রোভার, ল্যান্ড রোভার ,বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেনজ থেকে শুরু করে আরও নানান গাড়ি।একটি বিশেষভাবে মডিফায়েড বাস। তার ব্যক্তিগত একটি বেল হেলিকপ্টারও আছে।
রেড্ডির সোনা প্রেম
তার পোশাক নিয়েও নানা রকম কথা প্রচলিত আছে যা হল ,তিনি সোনার জরিপ দেওয়া জামা পরেন। অর্থাৎ তার জামা বিশেষভাবে সোনার সুতো দিয়ে নির্মিত হয় যার প্রতিটির দাম এমনিতেই১০ লাখ টাকার বেশি।এছাড়াও তার একটি বিশেষ অলংকার সমন্বিত বেল্ট আছে যার মূল্য ১৩ লাখ টাকা। এছাড়া সোনার প্লেটেড মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তিনি। তার বাড়িতে একটি ১ ফুট উচ্চতার সোনার ভগবান ‘ভেঙ্কটেশের মূর্তি ‘পাওয়া গিয়েছিল অন্য পাঁচটি মূল্যবান ধাতুর মূর্তির সঙ্গে বলে খবর পাওয়া যায়। এছাড়াও খবর পাওয়া যায় একটি ১কেজি ওজনের সোনার ঘন্টা পাওয়া গিয়েছিল তার বাড়ি থেকে।
দেবতার উদ্দেশ্যে স্বর্ণভক্তি
শোনা যায় তিনি একবার তিরূপতি মন্দিরে ভগবান তিরূপতির প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের জন্য৪৩কোটি টাকা মূল্যের মূল্যবান অলঙ্কার ধাতুর মুকুট নিবেদন করেছিলেন তার এক নিকট আত্মীয়ের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন : প্রকাশ্যে এল নরেন্দ্র মোদীর সম্পত্তির পরিমাণ! কত কোটি টাকার মালিক মোদীজি?
রাজনীতিতে রেড্ডি
কর্ণাটকের রাজ্য রাজনীতিতে রেড্ডি এক চেনা মুখ।তিনি বেল্লারি জেলার ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি পদ অলংকৃত করেছেন।২০০৬সালে কর্ণাটক বিধান কক্ষের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।পরে ইয়েদুরপ্পা সরকারের পর্যটন এবং পরিকাঠামো মন্ত্রীও হয়েছিলেন।এমনকি কেন্দ্রীয় স্তরে নীতিন গাটকারী এবং সুষমা স্বরাজের মতো নেতা নেত্রীও তার প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে।
আরও পড়ুন : বিশ্বের মহামূল্যবান এই ১০টি সম্পদ আছে মুকেশ আম্বানির কাছে
রেড্ডির কলঙ্ক
আরও পড়ুন : দিনে ৩০০ কোটি টাকা আয় মুকেশ আম্বানির! পরিসংখ্যান দেখলে চমকে যাবেন
কথায় বলে টাকা আর রাজনীতি দুই চুম্বকের বিপরীত মেরুর মতোই একে অপরকে আকর্ষন করে, তাই কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রেড্ডির বর্ণময় জীবনে এসেছে নানা কালিমাও।২০১১ সালে বেল্লারী অঞ্চলে অবৈধ লৌহ আকরিক খননের অপরাধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তাকে গ্রেপ্তার করে। চার বছর হাজত বাস কাটানোর পর২০১৫ সালে জামিনে মুক্ত হন তিনি। বর্তমানে আবার তিনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ঘেরাটোপে ।আর এই ভাবেই নানা বৈচিত্র্যে একজন অসাধারণ মানুষ হয়ে উঠেছেন তিনি।
কথায় বলে “পাপ বাপকেও ছাড়ে না” তাই আর্থিক প্রাচুর্য বা ধন-সম্পত্তির দম্ভে যদি কোন ব্যক্তি মনে করে যা করছেন সবই ঠিক তা কিন্তু বরাবরই ভুল বলে প্রকাশিত হয়েছে। আর বর্তমানে রেড্ডির ঘটনা আরেকবার তা সকলের সামনে এনে দিল।