সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই মানুষ প্রকৃতির কাছে অসহায়। কিন্তু সভ্যতার চাকা যতো অগ্রসর হয়েছে, মানুষ তার পারিপার্শ্বিক থেকে শিখেছে। আর নিজের কৌতূহলী শক্তির এই ক্রমবিকাশই আমাদের উপহার দিয়েছে নিত্যনতুন আবিষ্কার। আর এই সব নিত্যনতুন আবিষ্কারের যারা আবিস্কারক তাদের পরিচিতি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। সারা পৃথিবী জুড়েই এই উচ্চ মেধাযুক্ত বিজ্ঞানীদের ঠিকানা। আদি পৃথিবী থেকে বর্তমানের প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবী তৈরি করতে তাদের সব আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। আর এইসব আবিষ্কারকের মধ্যে আছে এমন কিছু সর্বদা স্বরণীয় ভারতীয় বিজ্ঞানী যাদের আজ আমরা এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্মরণ করবো। আর তাদের প্রতি জানাবো আমাদের পক্ষ থেকে বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সি. ভি. রামন (C V Raman)
এই মহান ভারতীয় পদার্থ বিজ্ঞানী প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করে ১৯৩০ সালে। আলোর বিচ্ছুরণের ঘটনার উপর গবেষনা করে তিনি তার প্রতিপাদ্য বিষয় উপস্থাপিত করেন। তিনি দেখান যে আলো যখন সমসত্ব স্বচ্ছ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যায় তখন কিছু আলোক রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘের পরিবর্তন ঘটে যা আলোক বিজ্ঞানে “রামন এফেক্ট” নামে পরিচিত। ৭ই নভেম্বর ১৮৮৮ তে তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন এই মেধাবী মানুষটি।এছাড়াও তিনিই প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি তবলা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের উপর শব্দের সরল দোল গতির পরীক্ষা করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি তার নিজের গবেষনাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।যদিও তার শরীরের অবস্থা দেখে ডাক্তারেরা জানিয়ে দেয় যে তিনি আর কয়েক ঘন্টা বাঁচবেন, কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।ও তারপরই তিনি হাসপাতালে না থেকে আবার নিজের কাজের জগতে ফিরে যান।তিনি রোগী হয়ে মরার থেকে তার তৈরি প্রতিষ্ঠান Raman Research Institute তে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে বেশি ইচ্ছুক ছিলেন।এই চির স্মরণীয় ভারতীয় ১৯৭০ সালের ২১ শে নভেম্বর পরলোকে গমন করেন।

হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা (Homi J. Bhabha)
বর্তমান পরমাণুধর রাষ্ট্র ভারতের পরমাণু বিদ্যার জনক বলা হয়ে থাকে এই মহান ভারতীয়কে। ১৯০৯ সালের ৩০ এ অক্টোবর বোম্বাইয়ে এই মহান পরমাণু বিজ্ঞানী জন্ম গ্রহণ করেন।তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বে গবেষণার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।স্বাধীন ভারতের শক্তি উৎসের প্রয়োজন মেটাতে ও ভারতে পরমাণু শক্তির সম্ভাব্য ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তাকে প্ৰথম চেয়ারম্যান করা হয়েছিল ভারতের Atomic Energy Commission এর।গ্রেট ব্রিটেনে তার পরমাণু বিজ্ঞানী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে এই মহান বিজ্ঞানী ভারতে ছুটে এসেছিলেন দেশকে স্বনির্ভর করার উদ্দেশ্যে।আর তাই তিনি তৎকালীন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে রাজি করিয়ে ভারতে পরমাণু প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। যদিও তিনি প্রথম থেকেই পরমাণু বোমা তৈরির বিপক্ষে ছিলেন।তিনি পরমাণুর ক্ষতিকর প্রভাবকে নষ্ট করে তাকে জনকল্যান মূলক কাজে অর্থাৎ শক্তির উৎস রূপে ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছেন।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ২৪শে জানুয়ারী ১৯৬৬ সালে এই মহান ভারতীয় পরমাণু বিজ্ঞানীর বিমান দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ঘটে । অনেকেই আবার তার বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাকে ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন আমেরিকার ।ভারতীয় পরমাণু প্রকল্পকে চিরতরে নষ্ট করার জন্য এরকম করা হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা।

মোক্ষগুঁড়াম বিশ্বেশ্বরাইয়া (Mokshagundam Visvesvaraya )
এই মহান ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার ,পণ্ডিত,ও রাজনেতার জন্ম হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯১২ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত তিনি মাইশোর (Mysore) এর নায়েব এর কাজও করেছিলেন তিনি।তিনি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “ভারত রত্নে” ভূষিত হয়েছেন এই মহান ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বাস করতেন ভারত শিল্প বিকাশের মাধ্যমে অন্যান্য শিল্পে উন্নত দেশের সঙ্গে সমকক্ষ হতে পারবে।তিনি স্বয়ংক্রিয় স্লাইস গেট(automatic sluice gates) ও ব্লক জলসেচ ব্যবস্থা(block irrigation system) র উদ্ভাবন করেছিলেন।যা আজও কারিগরি বিদ্যায় আশ্চর্যের উদ্ভাবন। তিনি নদীর তীরে জল সংশোধন বা পরিস্রুত করার জন্য সংগ্রাহক কুয়ো(Collector Wells)তৈরি করা শিখিয়েছিলেন যা সারা বিশ্বেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার জন্মদিন ১৫ই সেপ্টেম্বর ভারতে Engineer’s Day রূপে সম্মানের সহিত পালিত হয় ।

ভেঙ্কটারামন রাধাকৃষ্ণণ (Venkatraman Radhakrishnan)
১৮ই মে ১৯২৯ সালে তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের কাছে তনদরাইপেত নামক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন।তিনি একজন বিশ্ববিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী নামে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।এই মহান বিজ্ঞানী Royal Swedish Academy of Sciences এর একজন গুরুত্বপূর্ন সদস্য ছিলেন। তিনি সারা পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ ছিলেন একজন জ্যোতিপদার্থবিদ নামে এবং তিনি হালকা ওজনের উড়োজাহাজ ও নৌজাহাজের নকশা তৈরি করে সবার কাছে সমাদৃত হয়েছিলেন। তার পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতার সাহায্যে তিনি মহাকাশের অনেক রহস্যময় ঘটনা যেমন মহাকাশের গঠন,ও নানা মহাজাগতিক বস্তুর সম্বন্ধে ধারণা দিতে সাহায্য করেছেন। ৮১ বছর বয়সে তিনি বেঙ্গালুরুতে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এস. চন্দ্রশেখর (S. Chandrashekar )
১৯এ অক্টোবর ১৯১০ সালে পরাধীন ভারতের লাহোরে জন্ম গ্রহণ করেন এই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।পদার্থ বিজ্ঞানের এই কৃতী মানুষটি ব্ল্যাক হোল থিওরির উপর গাণিতিক প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়ে ১৯৮৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।তিনি সি. ভি রামানের সম্পর্কে ভাইপো ছিলেন ।১৯৫৩ সালে তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ছিল সাদা বামন তারাদের থেকে শক্তি বিচ্ছুরনের ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া যারা ক্রমশ ক্ষীয়মান নক্ষত্রে পরিণত হয়ে চলেছে।১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ২১ আগস্ট আমেরিকার শিকাগো শহরে এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী পরলোক গমন করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ( Satyendra Nath Bose )
প্রখ্যাত এই বাঙালি বিজ্ঞানী পয়লা জানুয়ারী ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন।ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী সত্যেন্দ্রনাথ কর্মজীবনে সম্পৃক্ত ছিলেন বৃহত্তর বাংলার তিন শ্রেষ্ঠ শিক্ষায়তন কলকাতা ,ঢাকা ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে।তিনি একজন গণিতজ্ঞ তথা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন।তার অন্যতম সেরা কাজ ছিল পদার্থের ক্ষুদ্রতম কনা নিয়ে তাত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া ,যা পরবর্তী সময়ে “বোসন কণা” নামে অভিহিত করা হয়।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর থাকার সময় প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তার নীতি ক্লাসিক্যাল পদার্থ বিদ্যা ছাড়াই প্রতিপাদন করে একটি গবেষনা প্রবন্ধ রচনা করেন এবং মৌলিক ও কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের ভিত্তি রচনাকারী প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে পাঠান।আইনস্টাইন এই প্রবন্ধের গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেই তা জার্মান ভাষায় রূপান্তরিত করে এক বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশ করেন।ফলে বিশ্বজোড়া তার পরিচিতি লাভ হয় এবং আইনস্টাইন ,লুই ডি ব্রগলি,মেরি কুরির মতো স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন।পরবর্তী সময়ে তাদের এই কাজ “বোস আইনস্টাইন পরিসংখ্যান”নামে জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার একমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ “বিশ্ব পরিচয়”এই মহান মানুষটির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত করেন। ১৯৫৪ সালে এই মহান বাঙালি বিজ্ঞানীকে ভারত সরকার “পদ্ম বিভূষন “সম্মানে সম্মানিত করেন। ৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে তিনি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মেঘনাদ সাহা ( Meghnad Saha )
অবিভক্ত ভারতবর্ষের ঢাকার শ্যাওড়াতলী গ্রামে ৬ই অক্টোবর ১৮৯৩ সালে এই মহান জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী জন্ম গ্রহণ করেন।তার শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে।তার বাবা একজন সাধারণ মুদি ছিলেন।আত্মীয়ের বাড়িতে ছোট খাটো কাজ বিনা পারিশ্রমিকে করে দেবেন এই শর্তে তিনি তাদের বাড়িতে থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।এই মহান বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানে থার্মাল আয়নাইজেসন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিখ্যাত।এছাড়াও তিনি পরমাণু বিজ্ঞান, আয়ন মণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন।দামোদর ভ্যালি করপোরেশন তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। তার আবিষ্কৃত থার্মাল আয়ানসেশন
সাহা আয়নিজেশন সমীকরণ ব্যবহার করে নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মাবলী ব্যাখ্যা করা হয়।এই মহান বাঙালি বিজ্ঞানী ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে মৃত্যু বরণ করেন।

শ্রীনিবাস রামানুজন (Srinivasa Ramanujan)
বর্তমান ভারতের অন্যতম গানিতজ্ঞ ২৩শে ডিসেম্বর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তামিলনাড়ুর ইরেভদ নামক জায়গায় জন্ম গ্রহণ করেন।যদিও তিনি খুব অল্প বয়সেই আমাদের ছেড়ে চলে যান, তবুও এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার অসামান্য গণিতের প্রতি জ্ঞানের পরিচয় দেন। ১০ বছর বয়সে তার পুঁথিগত গণিতের সাথে পরিচয় হয় আর এই অল্প বয়স থেকেই তিনি তার প্রতিভার নিদর্শন দেখাতে থাকেন।স্কুল ,কলেজ ,বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে প্রথাগত শিক্ষা না নিয়েও তিনি গণিতের বিভিন্ন শাখায় যেমন অসীম ধারা,আবৃত্ত ভগ্নাংশ,গাণিতিক বিশ্লেষণ সংখ্যা তত্ত্ব
ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছেন। ১২ বছর বয়সে এস এল লোনি লিখিত ‘’’ত্রিকোণমিতি’’’ পুস্তকটি অল্প বয়সে পড়েই তিনি ওই পুস্তকের বিভিন্ন অধ্যায় সম্বন্ধে দক্ষতা অর্জন করেন। এমন কি তিনি নিজে কিছু উপপাদ্যও আবিস্কার করেন।তিনি বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তার গণিতের প্রতি অসামান্য জ্ঞানের জন্য বৃত্তি পান । ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তিনি কুম্বকোনাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন।কিন্তু গণিতের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগের কারণে ইংরাজি বিষয়ে অকৃতকার্য হন।ফলে তার প্রথাগত পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।যদিও তিনি তার গণিতের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের উপর গবেষনার কাজ চলতে থাকে। “ম্যাজিক স্কোয়ার “গঠনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।যদিও তার গণিতের প্রতি এই অনুরাগ তাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল ,কিন্তু তিনি নিরামিষ ভোজন করা ও ওখানকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে পারে নি।ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়ে।ফলে তাকে আবার ভারতেই ফিরে আসতে হয় এবং এই মহান ভারতীয় গানিতজ্ঞ ৩২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।রামানুজন এবং তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে তার জন্মরাজ্য তামিলনাডু তার জন্মদিন ২২শে ডিসেম্বর ‘আই.টি. দিবস’ হিসেবে পালিত করে।

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose)
এই মহান বাঙালি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।তিনি একদিকে যেমন ছিলেন উদ্ভিদবিদ,জীব বিজ্ঞানী আবার অন্যদিকে তার পদার্থবিদ্যার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগ ছিল ও তিনি কল্প বিজ্ঞান রচয়িতাও ছিলেন।এই বাংলার মেধাবী বিজ্ঞানী ৩০এ নভেম্বর ১৮৫৮ সালে তৎকালীন বাংলার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন।এই মহান বিজ্ঞানীকে রেডিও বিদ্যার জনক বলেও অভিহিত করা হয়।তিনি তার গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভিদ বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।তিনিই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা করেন।তিনিই প্রথম যিনি অর্ধপরিবাহী জংশন ব্যবহার করেছিলেন রেডিও সিগন্যাল সনাক্ত করার জন্য এবং এই ভাবেই তারবিহীন সংযোগস্থাপন করতে পেরেছিলেন ও তা জনসমক্ষে দেখাতেও পেরেছিলেন।তবে তিনি তার এই পরীক্ষালব্ধ ফলকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন যাতে করে তা থেকে আরও আশাপ্রদ নুতন কিছু উদ্ভাবন হয়। তাই তাকে মুক্ত প্রযুক্তিরও জনক বলা হয়।এছাড়াও তিনি নূতন নুতন যন্ত্রের উদ্ভাবন করেন ।এমনই একটি যন্ত্র ছিল ক্রেসক্রোগ্রাফ,যার সাহায্যে তিনি দেখিয়েছিলেন উদ্ভিদ বিভিন্ন বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া দেয় যেমন চাপ, তাপ ইত্যাদি।তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি কল্প বিজ্ঞানের বই প্ৰথম বার লেখেন।অর্থাৎ এককথায় এই মহান ভারতীয় বিজ্ঞানী অর্থের জন্য বিজ্ঞান সাধনা না করে তা সকলের মঙ্গলের জন্য1 ব্যবহার করতে সদাই উদ্যত ছিলেন।এই মহান বাঙালি বিজ্ঞানী তথা বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তি ২৩শে নভেম্বর ১৯৩৭ সালে পরলোক গমন করেন।

বিক্রম সারাভাই ( Vikram Sarabhai )
এই মহান ভারতীয় বিজ্ঞানীকে ভারতের মহাকাশ গবেষণা ও বিভিন্ন মহাকাশ সংক্রান্ত কর্মসূচির জনক বলা হয়।পরাধীন ভারতবর্ষের গুজরাটের আহমেদাবাদে ১২ই আগস্ট ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।তিনি ভারত সরকারকে মহাকাশ গবেষনার ভবিষ্যৎ সাফল্যের কথা বুঝিয়ে ISRO(Indian Space Research Organization )স্থাপন করতে উৎসাহিত করেছিলেন।তিনিই ছিলেন Indian Space Research Organization এর প্রথম চেয়ারম্যান ।মহাকাশ বিজ্ঞানে তার অবদানের জন্য ১৯৬৬ সালে ভারত সরকার তাকে “পদ্ম ভূষণ” ও ১৯৭২সালে তার মৃত্যুর পর “পদ্ম বিভূষন” সম্মানে সম্মানিত করেন। এছাড়াও তিনি আহমেদাবাদে IIM (Indian Institute of Management) এর স্থাপনের পেছনেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।

সালিম আলি ( Salim Ali )
ভারতের প্রথম পক্ষী বিশারদ ও প্রকৃতিবিদ ১৮৯৬ সালের ১২ই নভেম্বর মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটো থেকেই তিনি তার নিঃসন্তান মামা মামীর কাছেই থাকতেন।তিনিই ভারতের প্রথম পক্ষী বিশারদ যিনি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পক্ষী গবেষনা শুরু করেন।তার লেখা পাখি বিষয়ক বিভিন্ন বই আজও সারা বিশ্বের দরবারে ভারতের বিভিন্ন রকম পাখিদের বর্ণনা দিতে সম্মানের সহিত সমাদৃত হয়।তিনি ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে কেওলাদেও জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত।এছাড়াও সাইলেন্ট ভ্যালি জাতীয় উদ্যানকে তার প্রচেষ্টায় রক্ষা করা হয়। ভারত সরকার তার প্রকৃতি সংরক্ষণের অবদানের জন্য তাকে ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্ম বিভূষন’ সম্মানে সম্মানিত করেন।পাখি বিষয়ে তাঁর অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি “ভারতের পক্ষীমানব” হিসেবে পরিচিত। তার নিজের আত্মজীবনীর নাম” দ্য ফল অফ আ স্প্যারো”। ২৭শে জুলাই ১৯৮৭ সালে তিনি পরলোক গমন করেন।

হর গোবিন্দ খুরানা ( Har Gobind Khorana )
পরাধীন ভারতের পশ্চিম পাঞ্জাবের রায়পুর গ্রামে এই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ৯ই জানুয়ারি ১৯২২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন।যদিও তিনি বহুদিন ধরে আমেরিকায় তার কর্মসূত্রে থাকার জন্য সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত জীব-রসায়ানবিদ।তিনি প্রথম জীব-রসায়ানবিদ যিনি কোষের মধ্যে প্রোটিন তৈরিতে নিউক্লিওটাইডের ভূমিকার কথা জানান। ১৯৬৮ সালে তিনি তার অসামান্য অবদানের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।১৯৭০ সালে তিনিই প্রথম কৃত্রিম জিন জীবন্ত কোষের মধ্যে সংশ্লেষ করতে সক্ষম হন।তার গবেষণা পরবর্তীতে জীব প্রযুক্তিবিদ্যা ও জিন থেরাপির ভীত স্থাপন করেন।এই মহান জীব-রসায়ানবিদ ৯ই নভেম্বর ২০১১ সালে মৃত্যু বরণ করেন।তার স্মৃতিতে ভারত ও আমেরিকা যৌথ উদ্যোগে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ম ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন- ম্যাডিসন, ইন্দো-আমেরিকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফোরাম “খোরানা প্রোগ্রাম” চালু করে।

বীরবল সাহানি
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পরাধীন ভারতবর্ষের পশ্চিম পাঞ্জাবে ১৪ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এই ভারতীয় প্রত্ন উদ্ভিদবিদ্।তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন জীবাশ্ম নিয়ে গবেষনা করেছেন।তিনি ভূপদার্থবিদও ছিলেন।এছাড়াও তার ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের দিকেও গভীর আকর্ষণ ছিল।তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন উফ
উদ্ভিদ নিয়ে গবেষনা করেছেন।তাকে ১৯৩৬ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত করা হয় একজন ভারতীয় উদ্ভিদবিদ হিসাবে।তিনি ভারতে “প্রত্ন উদ্ভিদ সোসাইটি “স্থাপন করেন যারা পরবর্তীতে প্রত্ন উদ্ভিদ ইনস্টিটিউট গঠন করে ১৯৪৬ সালে।১৯৪৯ সালে ১০ই এপ্রিল তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন।

এ পি জে আব্দুল কালাম ( APJ Abdul Kalam )
আবুল পাকির জৈনুলাবেদিন আব্দুল কালাম নামের বর্তমান প্রজন্মের একজন শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বিজ্ঞানী ১৫ই অক্টোবর ১৯৩১ সালে বর্তমান ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরম শহরে জন্মগ্রহণ করেন।শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ।তার পরিবার অত্যন্ত গরিব ছিল।এই গরিব অবস্থা থেকেই তিনি তার পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন।তিনি মেধাবীর সাথে সাথে কঠোর অধ্যবসায় করতেন।তিনি পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক করে পরবর্তীতে বিমান প্রযুক্তিতে শিক্ষা গ্রহণ করেন।পরবর্তীতে তিনি একজন এরোনটিক্যাল বিজ্ঞানী হিসাবে
ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থায় যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ভারতীয় মহাকাশ গবেষনা সংস্থায় বদলি হয়ে আসেন।সেখানে তিনি ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণকারী যান (এস এল ভি- III) এর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন যা ১৯৮০ সালের জুলাইয়ে ‘রোহিণী’ কৃত্রিম উপগ্রহকে তার কক্ষপথে স্থাপন করে। কালাম ১৯৬৫ সালে প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থায় স্বাধীনভাবে একটি বর্ধমান রকেট প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। তিনি ভারতীয় সেনার জন্য একটি হালকা ওজনের হেলিপ্টারের নকশা তৈরি করেছিলেন। এই মহান বিজ্ঞানী ভারতীয় ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেন।ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়। তিনি তার পুরো জীবন দেশের উন্নতির জন্য অতিবাহিত করেছেন। এছাড়াও তিনি ও তার দল দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রথম হোভারক্রাফট তৈরি করেন। এবং এর নামকরণ করেন নন্দী। ১৯৯৮ সালে ভারতের চালানো পারমাণবিক পরীক্ষাগুলোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তার জীবন সবার কাছেই চির আদর্শ হয়ে থাকবে।স্বামী বিবেকানন্দের পর এমন এক ভারতীয় যার কর্মের প্রতি আপামর সকল ধর্মের মানুষের বিশ্বাস ছিল। এই মহান কর্মপ্রাণ মানুষটি ২৭শে জুলাই ২০১৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।তার লেখা আত্মজীবনীর নাম “উইংস অফ ফায়ার”।
ভারতের মহামানবের সূচী এতো কম নয় ,পরবর্তীতে আরও অনেক মহা মানবদের নিয়ে আমাদের প্রতিবেদন থাকবে।