সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ সরকার বা যোগী আদিত্যনাথের সরকার উত্তরপ্রদেশে বিখ্যাত শহর এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে প্রয়াগরাজ করার কথা জানিয়েছেন। দেশীয় ভাবাবেগকে মাথায় রেখে উপনিবেশিক শাসনের সময় যে সব জায়গার নাম ইংরেজরা ঠিক করেছিল সেসব জায়গার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। দেশীয় উল্লেখযোগ্য ধর্মস্থান,পর্যটকস্থল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্মান জানানোর জন্য এই নাম পরিবর্তণ করা হয়। বিশেষ বিশেষ সময়ে রাজনৈতিক ভাবাবেগে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় এসেছে তখন তারা বিশেষ কিছু জায়গার নাম পরিবর্তন করে এক প্রকার চমক দিয়েছে। এরকম নাম পরিবর্তনের ঘটনা সাম্প্রতিককালে উত্তরপ্রদেশে ঘটেছে তা কিন্তু প্রথম নয়, সারা ভারত জুড়ে এরকম বিশেষ বিশেষ জায়গার নাম পরিবর্তনের ঘটনা ভুরি ভুরি উদাহরন দেখতে পাওয়া যায়। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ে এইরকম বিশেষ কিছু জায়গা যাদের অতীতের এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয়েছে।
এলাহাবাদ নামকরণের ইতিহাস
ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট আকবর উত্তরপ্রদেশে গঙ্গা নদীর তীরে প্রাচীন “প্রয়াগ “শহরের নিকট এক দুর্গ গড়ে তোলেন এবং পরবর্তী সময়ে ১৫৭৫ সালেএই শহরের নাম রাখেন এলাহাবাদ।
প্রয়াগরাজ নামকরণের যুক্তি
প্রয়াগ বলা হয় দুই নদীর সঙ্গমস্থলকে। কিন্তু এলাহাবাদে যে দেখা যায় তিন নদীর সঙ্গমস্থল ,তাই পবিত্র গঙ্গা ,যমুনা এবং সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলকে উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রয়াগরাজ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন। এছাড়াও যুক্তি অনুযায়ী প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ যেমন ঋগ্বেদ এবং মহাভারত ও রামায়ণে প্রয়াগরাজের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
তিরুচিনাপলি থেকে তিরুচিরাপল্লী
১৯৭১ সালে তামিলনাড়ুর প্রসিদ্ধ এই শহর নাম পরিবর্তন করে ত্রিরুচিরাপল্লী নামে আত্মপ্রকাশ করে। সাধারণত বিশ্বাস করা হয় তিন মস্তক যুক্ত দৈত্য ত্রিশিরা থেকে এই নামের উৎপত্তি।

বরোদা থেকে ভদোদরা
১৯৭৪সালে গুজরাটের বন্দর শহর বরোদা ,ভদোদরা নামে আত্মপ্রকাশ করে।ভদোদরা এই নামটি নেওয়া হয়েছিল বট পত্রক বা বট গাছের পাতা থেকে বা অনেকেই আবার তা বট গাছের হৃদয় থেকে বলে থাকেন।

তৃভান্দ্রাম থেকে তিরুবনন্তপুরম
১৯৯১সাল থেকে কেরলের রাজধানী শহর যা পূর্বে তৃভান্দ্রাম নামে পরিচিত ছিল তা তিরুবনন্তপুরম নামে আত্মপ্রকাশ করে।আসলে এই নামকরণের পেছন যুক্তি হল,মালায়লম ভাষায় তিরুবনন্তপুরমকে সন্ধি বিচ্ছেদ করলে পাওয়া যায় তিরু +অনন্ত+পুরম যার অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় ঈশ্বর “অনন্তের” শহর বা বাসভূমি যিনি বর্তমানে পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের প্রধান আরাধ্য দেবতা।

বম্বে থেকে মুম্বাই
অনেক মহারাষ্ট্রের অধিবাসী এর কাছে মুম্বাই শুধু মাত্র একটা শহর আর বোম্বে যেন তাদের আবেগ।১৯৯৬ সালে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী বম্বের নাম পরিবর্তন করে মুম্বাই রাখা হয়। এই নামকরণের পেছনে যুক্তি ছিল মুম্বাই শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় মুম্বা এবং আই। মহারাষ্ট্রের প্রখ্যাত জাগ্রত দেবী মুম্বা দেবীর নাম অনুসারে এবং মারাঠি ভাষায় মাকে ডাকা হয় আই বলে।

মাদ্রাজ থেকে চেন্নাই
মাদ্রাস নামটি ছিল উপনিবেশিক সরকার অর্থাৎ ইংরেজদের দেওয়া নাম যা মাদ্রাজপত্তানাম নামক এক মৎস আহরণকারী শহরের নাম থেকে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী ক্ষেত্রে চেন্নাই নামটি দেওয়ার পেছনে যে যুক্তি অনেকে দেখান তা হল, এখানে প্রসিদ্ধ চেন্না কেশভ পেরুমল মন্দির এর নাম অনুসারে, আবার অনেকে প্রসিদ্ধ তেলেগু রাজা দামাইলা চেনাপ্পা নায়াকুদুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করেন।

কোচিন থেকে কোচি
কেরালার এই বন্দর শহর ১৯৯৬ সালে কোচিন থেকে কোচি নামে আত্মপ্রকাশ করে। কখনো কখনো এই শহরকে স্থানীয় নামে এর্নাকুলাম বলেও ডাকা হয়ে থাকে। কচি নামের মালিয়ালাম অর্থ দাঁড়ায় ছোট্ট লেগুন বা ছোট্ট হদ।

ক্যালকাটা থেকে কোলকাতা
১৯১১ সাল পর্যন্ত উপনিবেশিক ভারতের রাজধানী এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির প্রাণকেন্দ্র বাংলার অর্থাৎ অবিভক্ত বাংলার ক্যালকাটা ২০০১ সালে সরকারিভাবে বাংলা ভাষায় এবং অন্যান্য সকল ভাষায় কোলকাতা নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই কোলকাতা নাম কলিকাতা নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মী জব চার্নক কলিকাতা, সুতানুটি এবং গোবিন্দপুর এই তিন গ্রাম নিয়ে উপনিবেশিক ক্যালকাটা স্থাপন করে।

পন্ডিচেরি থেকে পুদুচেরি
পন্ডিচেরি নাম ফরাসি উপনিবেশদের দেওয়া নাম যা পরবর্তীকালে২০০৬ সালে পুদুচেরি নামে আত্মপ্রকাশ করে। তামিল ভাষায় পদুচেরি কথার অর্থ হল নতুন শহর।

পঞ্জিম থেকে পানাজি
উপনিবেশিক গোয়ার রাজধানী পঞ্জিম যা পর্তুগিজ উপনিবেশ থাকার সময় দেওয়া হয়েছিল, ১৯৬০সালে এই শহরের নতুন নাম পানাজি রাখা হয়। কোঙ্কনি ভাষায় এই শহরকে পঞ্জি বলে ডাকা হয়। পঞ্জিম বা পানাজি সংস্কৃত শব্দ পঞ্জানি থেকে নেওয়া যার অর্থ নৌকা।
বেনারস থেকে বারানসী
ঋগ্বেদ উল্লিখিত এই শহরের নাম পবিত্র কাশী। যা পরবর্তী সময়ে উপনিবেশিক শাসন কালে এবং তারও কিছু আগে থেকে বেনারস নামে পরিচিত ছিল। ১৯৫৬সালে এই শহরের পুনরায় নামকরণ করা হয়। এই নামকরণের পিছনে যুক্তি হচ্ছে দুই নদী বরুনা এবং অসি এই দুইয়ের সঙ্গমস্থলে এই শহর গড়ে উঠেছে।

কালিকট থেকে কোঝিকোড়
১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা ভারতে যে জায়গায় প্রথম পদার্পণ করেন তা হলো গোয়ার কালিকট বন্দর। পরবর্তী সময়ে কালিকট শহর নাম পরিবর্তন করে মালিয়ালম ভাষায় কোঝিকোড় নামে আত্মপ্রকাশ করে যার অর্থ দাঁড়ায় রাজমহল এবং দুর্গের শহর।
আরও পড়ুন : ভারতের সেরা ১০টি ধনী রাজ্য ২০১৮; আপনার রাজ্য কত নম্বরে?
গৌহাটি থেকে গুয়াহাটি
আসামের রাজধানী এই শহরের প্রাচীন কালে যে নাম পাওয়া যায় তা হল প্রাগজ্যোতিষপুর। পরে এই শহরের নাম হয় গৌহাটি। ১৯৮০ সালে গুয়াহাটি নামে আত্মপ্রকাশ করে যা অসমীয়া ভাষায় গুয়া শব্দের অর্থ সুপারি এবং হাটি অর্থাৎ বাজার।

ব্যাঙ্গালোর থেকে বেঙ্গালুরু
ভারতের টেক সিটি বা সাইন্স সিটি নামে পরিচিত শহর যা পূর্বে ব্যাঙ্গালোর নামে পরিচিত ছিল তা বর্তমানে বেঙ্গালুরু নামে পরিচিত। যার অর্থ প্রহরীদের শহর।
আরও পড়ুন : ভারতের সমস্ত রাজ্যের নামের অর্থ এবং নামকরণের কারণ
এছাড়াও ম্যাঙ্গালোর থেকে মাঙালুরু, মাইসোর থেকে মাইসুরু, আলেপ্পি থেকে আলাপুঝা, উৎকামুন্ড থেকে উধগমন্দলাম, জব্বলপোর থেকে জবলপুর, তাঞ্জোর থেকে তাঞ্জাভুর, ওয়ালটায়ার থেকে বিশাখাপত্তনম, পুনা থেকে পুনে, ইন্দুর থেকে ইন্দোর, বেলগাঁও থেকে বেলাগাভি, কৌনপুর থেকে কানপুর ইত্যাদি শহরের নাম পরিবর্তনের ইতিহাস পাওয়া যায়।
ইতিহাস ঘাটলে এইরকম আরো ১০০টি শহরের নাম পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যাবে ।কিন্তু শেক্সপিয়ার এর সেই বিখ্যাত সংলাপটি মনে আছে,” নামে কি আসে যায়? গোলাপকে যে নামেই ডাকা হয় না কেন, সে তার গন্ধ ছড়াতে সে ভুল করে না। “তাই বর্তমান সরকার যদি নাম পরিবর্তনে বেশি না মাথা ঘামিয়ে প্রত্যেক মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তনের দিকে বেশি মাথা ঘামায় তাহলে দেশের উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে সকল বুদ্ধিজীবীরা।