উত্তর কাশ্মীরের সিয়াচেন হিমবাহ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশ এ জায়গাটি নিজেদের বলে দাবী করে। এখানকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হচ্ছে আবহাওয়া। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সিয়াচেন হিমবাহের উচ্চতা তের থেকে বাইশ হাজার ফুটের মধ্যে। অধিকাংশ সৈনিক মারা যায় তীব্র ঠাণ্ডা এবং তুষাড় ঝড়ের কারণে।
প্রায় ৭২ কিমি লম্বা এবং ২৫-৩০ কিমি চওড়া সিয়াচেন হিমবাহের পুরোটাই ভারতের দখলে। সিয়াচেনে ভারত-পাকিস্তান সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে, সেই পয়েন্ট এনজে ৯৮৪২-এর পূর্বে থাকা কারাকোরাম পর্বতশৃঙ্গ, পশ্চিমে সালতোরা গিরিশিরা এবং একদম উত্তরে ১৮ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় থাকা ইন্দিরা কলও রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে। সীমান্তের ওপারে পাক সেনার অবস্থান অনেকটাই নীচের দিকে। ফলে অবস্থানগত সুবিধা পায় ভারত। পরভেজ মুশারফ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন প্রাক্তন ভারতীয় প্রধানমনন্ত্রী মনমোহন সিংহ সিয়াচেন থেকে সেনা সরানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু ভারতের দাবি ছিল, বর্তমানে অবস্থান অনুযায়ী ম্যাপ বা স্যাটেলাইট ডকুমেন্টেশন-এ রাজি হয়নি পাকিস্তান। ফলে সিয়াচেন থেকে ভারতীয় সেনাও সরেনি।
১৯৮৪ সালে সিয়াচেনে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু হবার পর উভয় দেশ প্রায় আড়াই হাজার সৈন্য হারিয়েছে। এটি হচ্ছে আনুষ্ঠানিক হিসেব। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক-ভাবে জানা যায়, নিহত সৈনিকের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ হাজার। নিহতের মধ্যে ৭০ শতাংশই মারা গেছে আবহাওয়া-জনিত কারণে। ২০১২ সালে এক ভয়াবহ তুষাড় ঝড়ে পাকিস্তানের ১৪০জন সেনা সদস্য বরফের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে।
গত বছর বছর একই ধরনের ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর নয়জন নিহত হয়। কিন্তু এরপরেও কোন পক্ষই তাদের সামরিক শক্তি কমায় নি। ২০০৩ সালে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরের পরে সিয়াচেনে অবস্থানরত দুই দেশের সৈন্যদের তেমন একটা কাজ নেই। প্রতিদিন চার থেকে ছয় ঘণ্টা তারা টহল দেয়।
সারাবছর যাবত সিয়াচেনের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস বিশ ডিগ্রি। কিন্তু শীতকালে এ তাপমাত্রা থাকে মাইনাস পঞ্চাশ ডিগ্রি। শেভ করা, বাথরুমে যাওয়া কিংবা দাঁত ব্রাশ করা সাংঘাতিক কঠিন কাজ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে দিনেরে পর দিন এ ধরনের কাজ করলে হাতের আঙ্গুল জমে যায়। তীব্র ঠাণ্ডায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে হয়তো এক পর্যায়ে হাতের আঙুলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অকেজো হয়ে যায়। অনেক সময় কেটেও ফেলতে হয়।
এই উচ্চতায় কোনও মানুষের বেঁচে থাকাটাই বিস্ময়ের। বিজ্ঞানের নিজস্ব নিয়মেই, পাঁচ হাজার মিটারের উপর শরীর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। এই উচ্চতায় পর্বতারোহীরা যান, কিন্তু আবহাওয়া ভাল থাকলে তবেই পাহাড়ে ওঠেন তাঁরা। কিন্তু সেনাবাহিনীকে থাকতে হয় সারা বছর।
সিয়াচেনে নিয়মিত ঘন্টায় একশো মাইল বেগে ঝড় ওঠে। কখনও কখনও এই ঝড় টানা তিন সপ্তাহ স্থায়ী হয়। তুষারঝড়ে এই দীর্ঘ সময় ধরে পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় কোনও মানুষের বেঁচে থাকার নজির খুবই কম। অক্সিজেন কম থাকায় স্মৃতি চলে যায় অনেক সেনার। এই শিবিরে একবার থাকলে সমতলে ফিরে আসার পরও স্বাভাবিক হয় না শরীর।