রাখী বন্ধনের নেপথ্যের ইতিহাস; পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ও গুরুত্ব

রাখী পূর্ণিমার সৃষ্টি কখন হয়েছিল এই নিয়ে নানা মতভেদ আছে।তবে ধরা হয় আনুমানিক ৬,০০০ বছর পূর্ব থেকেই পুরাণের যুগের সময় থেকেই রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়। যদিও বর্তমান সময়ে আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এই উৎসব বাংলা জুড়ে প্রচলন করেছিলেন বড়ো আকারে। সাধারণত এই উৎসব প্রতি বছর শ্রাবন মাসের পূর্ণিমা তিথীতে পালন করা হয়।

রাখী বন্ধনের পৌরানিক উৎপত্তি

রাখী বন্ধন উৎসব নিয়ে ভারতীয় পুরাণে নানা রকম গল্প বা কাহিনী আছে। আসুন জেনে নি সেইসব গল্প বা কাহিনী..

পুরান মতে সুভদ্রা ভগবান শ্রী কৃষ্ণের ছোট বোন হওয়া সত্ত্বেও পঞ্চ পান্ডব পত্নী দ্রৌপদী কৃষ্ণকে দাদার মতো ভালোবাসত। শ্রীকৃষ্ণও দ্রৌপদীকে বোনের স্নেহ দিত। এই স্নেহ দেখে সুভদ্রার ঈর্ষা হতো। একদিন সুভদ্রা দাদা কৃষ্ণকে তার দ্রৌপদীর প্রতি এই অতি স্নেহ বৎসল হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন তাকে বলে, সঠিক সময়ে তিনি তার উত্তর পেয়ে যাবেন। তারপর একদিন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ যখন চেদী রাজ্যের রাজা শিশুপাল দ্বারা অত্যন্ত অপমানিত হন সেই সময় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তার বিনাশকারী অস্ত্র সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের শির:চ্ছেদ করেন, সেই সময় তার আপন অস্ত্র সুদর্শন দিয়েই তার হাত কেটে যায় সেই মুহূর্তে দ্রৌপদী সেইখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কৃষ্ণের এইরকম অবস্থা দেখে তার পরিহিত কাপড়ের একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে ওই কাটা অংশে তৎক্ষনাৎ বেঁধে দেন রক্তপাত বন্ধ করে দেবার জন্য।এই ভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার রক্তপাত বন্ধ করতে সাহায্য করেছিলেন দ্রৌপদী ,পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণ বিপদের সময় দ্রৌপদীর রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।এবং প্রতিশ্রুতি মতো যখন দ্রৌপদীরএইভাবেই পুরান অনুযায়ী রাখী বন্ধন উৎসবের প্রচলন হয়।যেখানে ভায়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে বোনেরা বা দিদিরা এবং দিদি বা বোনেদের সকল প্রকার সামাজিক এবং আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করার ভরসা দেয় ভাইয়েরা বা দাদারা।

আরও কথিত আছে ভগবান যম রাজের বোন যমুনা দাদার দীর্ঘায়ু কামনা করে তার হাতে রাখি বেঁধেছিলেন, সেই থেকেও রাখী বন্ধন উৎসব শুরু হয় বলে জানা যায়।

এছাড়াও কথিত আছে একবার এক হত দরিদ্র নারীর রূপ ধরে বানর রাজ বালির কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন ধন ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষী।তখন বানর রাজা বালি তার ডাকে সাড়া দিয়ে তার রাজপ্রাসাদে তাকে ঠাঁই দেন।খুশি হয়ে মাতা লক্ষী বানর রাজা বালির হাতে একটি কাপড়ের টুকরো বেঁধে দেন।যে দিন এই ঘটনাটি ঘটে সেই দিনটি ছিল শ্রাবন মাসের এক পূর্ণিমা।আর তাই এই দিনটিকেও অনেকেই রাখী বন্ধন উৎসবের সূচনা বলে মনে করেন।

আবার এও কথিত আছে ভগবান শ্রী গনেশের দুই পুত্র শুভ এবং লাভ একবার খুব জেদ ধরে তারা তাদের বোনের কাছেই রাখী পরবেন।উপায় না দেখে ভগবান গনেশ তার দুই স্ত্রী ঋদ্ধি এবং সিদ্ধির গর্ভ থেকে এক কন্যার সৃষ্টি করেন যিনি আমাদের কাছে সন্তোষী মাতা রূপে পরিচিত তিনি।তিনি তারপর দুই দাদা শুভ এবং লাভের হাতে রাখী বেঁধে দেন।সেই থেকেও রাখী বন্ধন উৎসব ভাইদের কল্যাণ কামনায় করা হয় বলে জানা গিয়েছে।

এছাড়া দানব রাজা বলি যখন তার শত যজ্ঞ পূর্ন করেছিলেন তখন তিনি মনে মনে স্বর্গের অধিপতি হওয়ার বাসনা নেন, দেবরাজ ইন্দ্র এই মনোবাসনা বুঝতে পেরে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়েছিলেন এবং তাকে এই ঘোরতর সমস্যা থেকে মুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেন।তখন ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার ধারণ করে রাজা বলির কাছে ব্রাহ্মণ অবতারে আসেন এবং তার কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন।রাজা বলি তখন তাকে বলেন তুমি কি চাও বলো ,আমি তোমাকে তাই দেবো।সেই সময় ব্রাহ্মণ বেশী ভগবান বিষ্ণু তার কাছে তিন পদ জমি চেয়ে বসেন।আর রাজা বলিও তা পূর্ন করার  প্রতিজ্ঞা করেন।তখন বামন রূপে ভগবান বিষ্ণু এক পায়ের দ্বারা স্বর্গরাজ্য এবং অন্য পায়ের দ্বারা সমস্ত পৃথিবী নিজের অধিকারে নিয়ে নেন এখন তার কাছে এক পদ জমি বাকি ছিল ।

তখন নিরুপায় হয়ে রাজা বলি বামন রূপী ব্রাহ্মণ কে তার অন্তিম পদ তার মাথায় রাখতে বলেন এবং এইভাবে এক পা রাখলে রাজা বলি তিনি পাতালবাসী হন।এইভাবে তার কথা রাখতে পারার জন্য ভগবান বিষ্ণু তার নিজরূপ ধারণ করে রাজা বলির উদ্দ্যেশ্যে বলেন ,যে তিনি তার এইরূপ প্রতিজ্ঞা রাখায় সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তার যদি কিছু চাওয়ার থাকে তাহলে ভগবান বিষ্ণুর কাছে কোন রূপ সংকোচ ছাড়াই চাইতে পারে।তখন রাজা বলি ভগবান বিষ্ণুকে সবসময় তার কাছে যেন তিনি থাকেন এইরূপ একটি বর ভিক্ষা করেন।এইভাবে বর দেওয়ার ফলে ভগবান বিষ্ণুকে রাজা বলির কক্ষের দ্বাররক্ষী হতে হয়।ভগবান বিষ্ণুর পত্নী মা লক্ষী যখন এই বিষয় জানতে পারে তখন তিনি নারদের কাছে এই অবস্থা থেকে ভগবান বিষ্ণুর বাঁচার উপায় জানতে চান ।নারদ তখন মা লক্ষীকে উপদেশ দেন ,তিনি যেন রাজা বলিকে রাখী বেঁধে তাকে নিজের ভাইয়ের মর্যাদা দেয় এবং বিনিময়ে যখন রাজা বলি তাকে কিছু দিতে চাইবে তখন মাতা লক্ষী যেন ভগবান বিষ্ণুকে চেয়ে নেন।এইভাবে রাখী বেঁধে নারদের উপদেশ মতো মা লক্ষী রাজা বলিকে রাখী পরিয়ে ভাই বানিয়ে তার পতি ভগবান বিষ্ণুকে উদ্ধার করেন।যেদিন তিনি রাজা বলিকে রাখী বেঁধেছিলেন সেই দিনটিও নাকি শ্রাবন মাসের এক পূর্ণিমা তিথি ছিল ,আর এই থেকে তাই শ্রাবন মাসের পূর্ণিমা তিথীতে রাখী বন্ধন উৎসব চালু হয়।

রাখী বন্ধনের ঐতিহাসিক উত্‍পত্তি

মুঘল সম্রাট হুমায়ুন এবং মেবারের রাজপুত রানী কর্ণবতীর মধ্যে ভাই বোনের খুব দৃঢ় সম্পর্ক ছিল। তার স্বামীর মৃত্যু হওয়ার পর একবার যখন গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ  মেবার দখল করার জন্য আক্রমন করে তখন মেবারের রানী কর্ণবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তার সাথে একটি রাখীও পাঠান তার উদ্দ্যেশ্যে।সেইসময় হুমায়ুন বোনের ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে এবং তার রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য সেনা পাঠিয়ে সাহায্য করেন।এইভাবে রাখী পাঠানোর মাধ্যমে ভাই বোনের সম্পর্ক  এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে ।

অনেকে আবার বলেন আলেকজান্ডারের এবং পুরুর যুদ্ধের সময় আলেকজান্ডারের পত্নী রুকসানা পুরুকে রাখী পাঠান আলেকজান্ডারকে হত্যা না করার জন্য।আর এই রাখী পেয়ে পুরু তার কথা রাখেন এবং যুদ্ধ চলার সময় তিনি রাজা আলেকজান্ডারকে হত্যা করেন নি।

তবে বর্তমান সময়ের মধ্যে আমরা রাখীর ব্যবহার দেখতে পাই হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি বজায় রাখতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা জুড়ে রাখী পূর্ণিমা করতে আহ্বান জানান বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫সালে।আর এইভাবে রাখী  ভাই বোনের সম্পর্কের ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণতাকে অতিক্রম করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নিদর্শন রূপে পরিলক্ষিত হয়।

তাই  আসুন আমরাও সবাই রাখী পূর্ণিমার শুভ মুহূর্তে সকলকেই রাখী বেঁধে নিজেদের মধ্যে ধর্ম, বর্ন, জাতি, রং সব ভুলে গিয়ে মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়।তাহলেই হবে প্রকৃত রাখী পূর্ণিমা উদযাপন।এবং সংকল্প করি সকল পরিচিত এবং অপরিচিত নারীদের সম্মান রক্ষা করার কাজে আমরা সবসময় এগিয়ে থাকবো এবং অবশ্যই তাদের প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করবো।