বসন্ত এসেছে দুয়ারে আর তারই হাত ধরে এসেছে পলাশের লাল ফুল।অৰ্থাৎ রঙিনের সমাহার চারিদিকেই।আর তাই রঙের উৎসব দোল পূর্ণিমা বা হোলি গুটিগুটি পায়ে আমাদের আনন্দ দিতে হাজির।এই রঙের উৎসবের সারা ভারত ব্যাপী নামে অনেক ব্যাপকতা।কোথাও এই উৎসব হোলি খেলা আবার কোথাও তা দোল পূর্ণিমা নামেও পরিচিত।কিন্তু মূল যা আনন্দ তা রঙের।অৰ্থাৎ রঙে নিজের ও অন্যের মনকে রাঙিয়ে দেওয়া।তাই আসমুদ্র হিমাচল এই উৎসবে মেতে ওঠে।
প্রত্যেক প্রদেশই তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে।তবে সব আনন্দের উচ্ছাস প্রকাশ পায় রং দিয়ে।কোথাও আবিরের ব্যবহার বেশি।আবার কোথাও নানান তরল রঙে সবকিছু রাঙিয়ে নেওয়া।এই একটি উৎসব ধর্মের ,জাতির সকল ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে কাছে ডেকে আনে।পরকে করে আপন।চেনা অচেনা সকলেই এই আনন্দের উৎসবে মেতে উঠি আমরা ।রঙের লালিমায় সবাই যেন এক হয়ে যায়। মনের সকল বিষাদ, সকল না পাওয়া ,সকল সাদা কালো দূর হয়ে সব যেন হয়ে ওঠে রঙিন ,প্রাণবন্ত।দূরে সরে যায় আমাদের ধর্ম, বর্ন, জাতপাতের ভেদাভেদ।তাই হোলি আজ আর ভারতের উৎসব নয়, এই উৎসব হয়ে উঠেছে এক আন্তর্জাতিক উৎসব।এই উৎসব ভারতের বৈচিত্রকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।
হোলি উৎসবের শুরুর পৌরানিক কাহিনী
হোলি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে” হোলা”শব্দ থেকে।আর এই হোলা কথার অর্থ হল আগাম ফসলের প্রত্যাশায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা।আবার অনেকের মতে হোলি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ “হোলকা” থেকে এসেছে।যার অর্থ হলো অর্ধপক্ক শস্য।ভারতের কিছু প্রদেশ যেমন পাঞ্জাব ,হরিয়ানা প্রভৃতি জায়গায় অর্ধ পক্ক গম ও ছোলা খাওয়ার রীতিও আছে।তবে হোলি শুরুর এক বিখ্যাত পৌরানিক গল্পও আছে, যা আমরা অনেকেই জানি।
গল্পটি হল এরকম
হিরণ্যকশিপু নামের এক দৈত্য রাজা বাস করত পুরাকালে। সে ছিল মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির পুত্র।সে একবার ভগবান ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করেছিল। তার ভক্তি তে খুশি হয়ে ভগবান ব্রহ্মা রাজা হিরণ্যকশিপুকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছিল।কিন্ত এই বিশেষ ক্ষমতা পেয়ে পরবর্তী কালে অত্যন্ত অহংকারী হয়ে ওঠে হিরণ্যকশিপু ।ব্রহ্মার বরে হিরণ্যকশিপু দেবতা ও মানব বিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবহেলা করতে শুরু করে।এই দৈত্য রাজা তখন তার প্রজাদের বিষ্ণুর এবং অন্যান্য সকল দেবতাদের উপাসনা বন্ধ করে সমগ্র রাজ্যে নিজের উপাসনা করতে বাধ্য করে। হিরণ্যকশিপুর এক পুত্র ছিল।তার নাম প্রহ্লাদ ,সে ছিল ছোটবেলা থেকেই প্রকৃত বিষ্ণু ভক্ত।সে তার পিতার আদেশে কখনওই বিষ্ণুর উপাসনা ত্যাগ করে পিতার উপাসনা করতে রাজি ছিল না।হিরণ্যকশিপু পুত্রের এইরূপ আচরণে অত্যন্ত ক্রোধিত হয়েছিল।তাই সে নিজের সন্তানকে মারার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে।হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে মেরে ফেলার জন্যে কখনো তার খাবারে বিষ প্রয়োগ করে, আবার কখনো মত্ত হাতীর পায়ের নীচে তার পুত্র প্রহ্লাদ কে ফেলে দেয়।কিন্তু বিষ্ণু ভক্ত প্রহ্লাদ প্রতিবারই বেঁচে যায়।তাই সে তার পুত্রকে বিষধর সাপেদের সঙ্গেও কারারুদ্ধ করে রাখে, কিন্তু কোনভাবেই তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয় না।
শেষমেষ কোনো উপায় না দেখে তার বোনকে তার একমাত্র পুত্রকে মারতে বলেন।তার বোনের নাম ছিল হোলিকা। হোলিকার এক বিশেষ মন্ত্রপূত শাল ছিল যা তাকে সবসময় আগুন থেকে রক্ষা করত।তাই দৈত্য রাজা হিরণ্যকশিপু ভেবেছিল বোন তার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে আগুনে বসবে আর আগুনের তাপে তার সন্তানের মৃত্যু ঘটবে।কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো ঘটনা ঘটেছিল।দাদার আদেশে হোলিকা এক বিশাল অগ্নিকুন্ডে ভাইপো প্রহ্লাদকে নিয়ে বসে।কিন্তু ঈশ্বর যার সহায় তাকে মারার ক্ষমতা কারো কি আছে?তাই অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করার পর অদ্ভুতভাবে, আগুনে পুড়ে হোলিকার মৃত্যু হয়। বেঁচে যায় ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত প্রহ্লাদ।হোলিকার মন্ত্রপূত শাল , যা তাকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করত তা তাকে আগুন থেকে রক্ষা করতে পারে নি।রক্ষা করেছিল প্রহ্লাদকে।
কথিত আছে, প্রহ্লাদ আগুন প্রবেশ করলে অনেক জোরে চারিদিক থেকে শক্তিশালী বাতাস বইতে থাকে এবং সেই মায়াবী শাল হোলিকার পরিবর্তে প্রহ্লাদকে ঘিরে রাখে। আগুনে পুড়ে হোলিকার মৃত্যু হয়। হোলিকা দহনের পর নৃসিংহরুপ ধারণ করে ভগবান বিষ্ণু হিরণ্যকশিপুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে দু টুকরো করে ফেলে হত্যা করে। আর তাই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় হোলি উৎসব।দোলের আগের দিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ অগ্নিকুন্ডের আয়োজন করা হয়,যা চাঁচর বা নেড়াপোড়া নামে পরিচিত।তাই অনেকেই এই উৎসবকে অশুভের উপর শুভের জিত বা খারাপের উপর ভালোর জিত বলেও বর্ণনা করে।ভারতের পাঞ্জাবের মুলতানের সূর্য মন্দির এই ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে।
আবার “দোল পূর্ণিমা”র উৎপত্তি সম্পর্কে বাঙালি বা বৈষ্ণব মতেও এক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।সাধারণত ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথীতে রাত্রি বেলায় হয় দোল উৎসব।এই উৎসবে প্রধানত রাধাকৃষ্ণের চরণে ভক্তিভরে আবির দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়, তার সাথে চলে কীর্তন ও ভজন।পরে সেই নানা রঙের আবির মাখিয়ে সবাইকে রাঙানো হয়।বৈষ্ণব মত অনুযায়ী এই দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাধিকা ও অন্যান্য সখীদের সঙ্গে আবির বা গুলাল নিয়ে মেতেছিলেন রং খেলায়।তাই এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মূলত পশ্চিমবঙ্গে ও উত্তরপ্রদেশে দোল পূর্ণিমা মহা ধুমধামে পালন করা হয়।আবার অনেকের মতে এই ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথীতে শ্রীকৃষ্ণের মানবরূপী অবতার শ্রী চৈতন্যদেব নদিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন।তাই এই পূর্ণিমাকে অনেক বৈষ্ণব গৌর পূর্ণিমাও বলে থাকেন।তবে উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন সাধারণত পালন করা হয়।
আরো পড়ুন : ভারতের সবচেয়ে পবিত্র ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ এর নাম, অবস্থান ও তাদের সৃষ্টির ইতিহাস
তাই আমরা দেখলাম “হোলি “এবং’দোল পূর্ণিমা” উৎসব পালনের পৌরানিক ব্যাখ্যা।তবে সব জায়গাতেই এই দুই উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষ রং খেলার আনন্দে মেতে ওঠে।