পৃথিবীতে মা দুর্গার পূজার উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত বা কথা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের মা দুর্গার অকাল বোধনের কাহিনী। এখানে আমরা জানতে পারি ভগবান শ্রী রাম রাবনকে হত্যা করার জন্য সাধারনতো অকালে অর্থাৎ শরৎকালের মা দুর্গার পুজো করেছিলেন তাই একে অকালবোধনও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই সমস্ত তথ্য সবই পুরাণের উপর ভিত্তি করে রচিত। বর্তমানে আমাদের দেশে অর্থাৎ ভারতে আধুনিক যুগে মা দুর্গার পূজার উৎপত্তি সম্বন্ধে সঠিক ব্যাখ্যা আমরা পাই না। যেটুকু তথ্য আমরা পঞ্জিকা বা প্রাচীন গ্রন্থ ঘেঁটে পেয়েছি তাতে যেমন আছে বিভিন্ন ব্যাখ্যা, তেমনি আছে নানা রকমের মতবিরোধ।সাধারোনত ১৭শতকের আগে ইতিহাস খুঁজে দেখলে আমরা ভারতে মা দুর্গা পূজার সার্বজনীন রূপ নিয়ে উল্লেখ খুব একটা পাই না। যদিও মা দুর্গার পূজা সেই সময় ভারতে আর্য এবং অনার্য সবার মধ্যে প্রচলন ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৭শতকের পরবর্তী সময়গুলিতে মা দুর্গার পূজার বৃহদাকারের প্রচলন দেখা যায়।
কিন্তু একটা রহস্য আজও অনেকের মধ্যে থেকে ভেসে আসে যে ভারতে বা আমাদের বাংলায় যে সার্বজনীনভাবে দুর্গাপুজো এতবড় একটা উৎসবের মতো করে পালন করা হয় তার পিছনে কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অর্থাৎ ইংরেজরাই নাকি ভারতে অর্থাৎ বাঙ্গালীদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিল দুর্গাপুজোকে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা সেই রহস্য খোঁজার চেষ্টা করব ।
১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ভারতীয় তথা বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় রবার্ট ক্লাইভ এর নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। এই লড়াই যদিও ইংরেজদের জন্য ছিল এক অসম লড়াই। কিন্তু তারা সুচতুরভাবে ভারতীয় অর্থাৎ বাংলার নবাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পাদাধিকারী লোককে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নিজেদের দিকে টেনে নিতে পেরেছিল যার ফলে সিরাজের সৈন্যের একের দশ অংশ নিয়েও জয়ী হয়েছিল রবার্ট ক্লাইভের মুষ্টিমেয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদল মাত্র ঘন্টার লড়াইয়ে সিরাজের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে এবং পরবর্তী সময়ে সিরাজকে হত্যা করা হয়েছিল। এইভাবে বাংলার মসনদ দখল করে নিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
এই সময় রবার্ট ক্লাইভ বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে তার জয়লাভকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন চার্চে গিয়ে গড এর কাছে প্রার্থনা করার মাধ্যমে। কিন্তু সেই সময় কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত অন্যতম চার্চ নবাবের বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল ,তাই সেখানে গিয়ে জয়ের জন্য গড়ের কাছে কৃতজ্ঞতা ও আশীর্বাদ লাভ করার কোনো সুযোগ ছিল না রবার্ট ক্লাইভের। এই সময় রবার্ট ক্লাইভের বাঙালি সহকারী যিনি তাকে পারসি ভাষা অনুবাদ করে দিতেন সেই বাঙালি নবকৃষ্ণ দেব তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন ফাদারের কাছে বা গির্জায় না গিয়ে তিনি তার এই সফলতা বা জয় উৎসর্গ করে যেন মা দুর্গার পূজার মাধ্যমে।তিনি আরও তাকে বলেছিলেন, তার এই জয়ের জন্য মা দুর্গাকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পূজা করে একদিকে যেমন হিন্দু বাঙালীর মনকে কাছে টানতে পারবেন, তেমনি অন্যদিকে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করা অনেক বেশি সহজ হবে।
এই উপদেশ চতুর রবার্ট ক্লাইভের বাংলাকে তথা ভারতকে দীর্ঘদিন শাসন করার স্বপ্নকে সত্যি করার পথকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছিল। আর তাই রবার্ট ক্লাইভ বাংলার হিন্দুদের মন জয় করার জন্য এই সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করতে চাইনি ।সেই জন্যই খুবই ঘটা করে নবকৃষ্ণ দেব বাবুর রাজবাড়ীতে করা হয় সেই বছর দুর্গাপুজো ।যা পরবর্তী সময়ে বাংলার নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল আজকের সার্বজনীনতার রূপ নিয়ে।
যদিও অনেক ঐতিহাসিকদের মতে ১৭৫৭সালে পলাশীর যুদ্ধের আগেও বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল।কিন্তু সার্বজনীনভাবে দুর্গাপুজোর যে প্রচলন আজকে আমরা দেখতে পাই সমগ্র বাংলা জুড়ে তার অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছে অন্য কিছু কথা। সাধারণত ১৭৫৭সালের আগে বাংলার বনেদি বা জমিদার পরিবারগুলিতে দূর্গা পূজা করার প্রথা চালু ছিল। যার উপলক্ষে সাধারণদের মধ্যে খুব একটা যে উৎসাহ ছিল তা কিন্তু নয়। এই উৎসব তখন বনেদি পরিবার বা জমিদারদের আভিজাত্য দেখানোর অন্যতম সেরা মাধ্যম ছিল ।দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে সারা গ্রামের লোক জড়ো হতো জমিদারদের পূজামণ্ডপে। মাকে দর্শন করে তারাও আরতি দেখতো এবং অন্যান্য মঙ্গল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করতো। পরবর্তী সময়ে সার্বজনীন দুর্গাপূজা প্রথা চালু হতে থাকে এবং বর্তমানে দূর্গাপূজা উৎসবে বাঙালির মধ্যে ধর্ম, জাতি ,বর্ণ এবং আর্থিক পার্থক্য দূরে রেখেও সকলের সমান উৎসাহ ও আনন্দে উদ্দীপনা দেখা যায়।
আরও পড়ুন : ব্রিটিশরা শাসন না করলে কেমন হত ভারতের চেহারা ?
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় “সনাতন ধর্ম উৎসাহিনী সভা” ১৯১০সালে বাগবাজারে প্রথমবার সার্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল আর একেই প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপূজা উৎস বলে ধরা হয়। এরপর পরবর্তী সময় ১২টি সম্ভ্রান্তশালী পরিবার একত্রিত হয়ে দুর্গা পূজা করার প্রথা চালু করেন, যা পরবর্তী সময়ে বারোয়ারি দুর্গাপূজা নামে পরিচিত হয়েছিল। পূজোর আনন্দের অনুভূতি এভাবে যখন রাজ্যজুড়ে ধনী এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল তখন প্রত্যেকে চাইছিলো এই শুভ অনুষ্ঠানের শরিক হতে। এভাবেই বাংলার শহর জুড়ে এবং পরবর্তী সময়ে গ্রামগুলিতেও অনেক পরিবার ধীরে ধীরে অর্থ সংগ্রহ করে বারোয়ারি বা সার্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু করে যা আজকে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। আর তাই এখন দুর্গা পুজো বাঙালির পুজো না হয় এক আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে যেখানে প্রতিটি পূজামণ্ডপ আমাদের সামনে তুলে ধরে নতুন নতুন শিল্পকলা এবং শিল্প বৈচিত্র্য এবং অসাধারণ সব শিল্পকর্ম।
তাই মানুন আর নাই মানুন বাঙালির এই সাধের পুজোর দুর্গাপূজার সার্বজনীনতা ও জনপ্রিয়তার নিয়ে আসার পেছনে ইংরেজদের যে একটা বড় ভূমিকা ছিল তা একবাক্যে স্বীকার করে নিতে হয়।