কার জন্য আজও অবিবাহিত লতা মঙ্গেশকর, নেপথ্যে এক অসম্পূর্ণ প্রেমকাহিনী

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সংসারের ভার এসে পড়েছিল তার কাঁধে। বাবার আচমকা মৃত্যুতে চার ভাইবোন এবং বিধবা মায়ের সংসারে নেমে এসেছিল অন্ধকার। সেই অন্ধকার দূর করার দায়িত্ব তখন সেদিনের সেই কিশোরী মেয়েটিই নিজের কাঁধে তুলে নেয়। আজ তিনি বলিউডের (Bollywood) কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। যার গান ছাড়া বলিউড সংগীতদুনিয়ার সমৃদ্ধি সম্ভব ছিল না।

প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব এবং ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী দীননাথ মঙ্গেশকরের মেয়ে লতা মঙ্গেশকর। গোয়ার মঙ্গেশি গ্রামের পূজারী ব্রাহ্মণের বংশের উত্তরাধিকার ছিলেন দীননাথ। তার বাবা অর্থাৎ লতার ঠাকুরদা গণেশ হার্দিকর ওই গ্রামের শৈব পীঠস্থান নামে পরিচিত ‘মঙ্গেশি‘ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। লতার ঠাকুরমা যেশুবাঈ ছিলেন গোয়ার দেবদাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। পরবর্তীকালে হার্দিকর পদবী পরিবর্তন করে তারা মঙ্গেশকর পদবী রাখেন।

 

১৯২২ সালে গুজরাতি ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে নর্মদাকে বিয়ে করেন দীননাথ। তবে তাদের একমাত্র মেয়ে লতিকার মৃত্যুর পর নর্মদাও শোকে প্রয়াত হন। প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পর দীননাথ তার বোন সেবন্তীকে বিয়ে করেন। ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইনদওরে জন্ম হয় তাদের প্রথম সন্তান হেমার। যার নাম নাম পরে লতিকা থেকে লতা রাখা হয়।

খুব ছোটবেলায় বাবার কাছেই গানের হাতেখড়ি হয় লতার। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি বাবার নাটকে অভিনয় করেন। ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত সব ভালোই চলছিল। কিন্তু বাবার আচমকা মৃত্যুতে তাদের সংসারে নেমে আসে অভাব। ছোট ছোট তিন ভাইবোন আশা, ঊষা এবং হৃদয়নাথের মুখের দিকে তাকিয়ে ওই বয়সেই অভিনয় করতে শুরু করেন লতা। ১৯৪২ সালে মরাঠি ছবি ‘কিটি হাসাল’-এ প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগও পেয়ে যান তিনি। তবে সেই গান পরে বাদ পড়েছিল।

lata mangeskar family

১৯৪৫ সালে লতা চলে আসেন মুম্বাইয়ে। একদিকে ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন তিনি, অপরদিকে বলিউডের বিভিন্ন সিনেমাতে প্লেব্যাক করতে থাকেন সংসার চালানোর তাগিদে। এখানেই তার পরিচয় হয় গুলাম হায়দরের সঙ্গে। তার হাত ধরে লতা পৌঁছে যান প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কিন্তু প্রযোজক লতার গান শুনে তাকে খারিজ করে দেন। এতে বেজায় চটে যান হায়দার। তিনি প্রকাশ্যেই প্রযোজককে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, সারা ভারত বর্ষ একসময় লতাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে!

তার সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। ১৯৪৮ সালে হায়দারের ‘মজবুর’ ছবিতে প্রথমবার গান গাওয়ার সুযোগ পান লতা। তার গাওয়া ‘দিল মেরা তোড়া’ গানটি হয়েছিল সুপারহিট। ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ ছবিতে ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গান লতাকে রাতারাতি জনপ্রিয়তার শিখরে তুলে দেয়। সবটাই সম্ভব হয়েছিল হায়দারের জন্য। তাই লতা আজও তাকে নিজের গডফাদার বলে মানেন।

সারাদেশে প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। তার গানের সংখ্যা অগুনতি। তিনি নিজেও নিজের গানের সংখ্যার খোঁজ রাখেননি। এত খ্যাতি, এত জনপ্রিয়তা, পুরস্কার-জাতীয় পুরস্কারের ভিড়ে তার শত্রু সংখ্যাও কিছু কম ছিলনা। ১৯৬২ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় লতাকে। খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে তিন মাস হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল তার রাঁধুনির দিকে। যদিও সেই রাঁধুনিকে পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে কোনও ষড়যন্ত্রই বলিউডের নাইটিঙ্গেলকে দমিয়ে দিতে পারেনি। লতাই প্রথম ভারতীয় সংগীতশিল্পী, যিনি লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে পরিচয় ছবির ‘বিতি না বিতাই র‌্যায়না’ গানের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পান। এরপর ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৭১ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০১ সালে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হন লতা।

প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না তিনি। স্কুলে গিয়েছেন মাত্র একদিন। বাড়িতেই পড়াশোনা করেছেন। অভাবের তাড়নায় হাতে যে মাইক তুলে নিয়েছিলেন তিনি, তাই পরবর্তীকালে তার ভাগ্য বদলে দেয়। ব্যক্তিগত জীবনে আজীবন অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নেন লতা। প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা প্রাক্তন ক্রিকেট প্রশাসক প্রয়াত রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন উঠেছিল। যদিও প্রকাশ্যে তারা দুজনেই সে কথা অস্বীকার করেন। লতার মতো রাজ সিংহও আজীবন অবিবাহিত থেকেছেন।

শৈশবকালে কুন্দনলাল সেহগলের চলচ্চিত্র ‘চণ্ডীদাস’ দেখে তিনি বলেছিলেন, বড় হয়ে সেহগলকেই বিয়ে করবেন তিনি। কিন্তু তারা বিয়ে করেননি। তিনি জানান, পরিবারের সকল সদস্যের দায়িত্ব তার ওপর ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বিয়ের চিন্তা এলেও সেটাকে গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবতেই পারেননি তিনি। সঙ্গীতকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন বেছে নেন লতা মঙ্গেশকর।