গণেশ পূজা সাধারণত ১০দিন ধরে চলে। শুরু হয় ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্থী তিথিতে অর্থাৎ এবছর ১৩ই সেপ্টেম্বর এবং গণেশ মূর্তি বিসর্জন করা হবে অনন্ত চতুর্দশী অর্থাৎ ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে।
পূজার সময়ের নির্ঘন্ট
গণেশ চতুর্থী বা গণেশ পূজার শুভ সময়কে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা লাভ মুহূর্ত, অমৃত মুহূর্ত এবং শুভ মুহূর্ত। বাড়িতে গণেশের মূর্তি নিয়ে আসার সেরা সময় হল লাভ মুহূর্ত থেকে অমৃত মুহূর্ত পর্যন্ত সময় কালে। ভগবান গণেশের আরাধনা বা পূজা করার সঠিক সময় হল শুভ মুহূর্ত। ১৩ই সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিট থেকে দুপুর ১৪ টা ৭ মিনিট বা দুপুর ২ টো ০৭ মিনিট পর্যন্ত সময় কাল লাভ মুহূর্ত থাকবে। শুভ মুহূর্ত শুরু হবে বিকাল ৫ টা ১০ মিনিট বা ১৭ টা ১০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬ টা ৪২ মিনিট পর্যন্ত। তবে লোকমতে এই বিশ্বাস আছে যে গণেশ চতুর্থীর দিন ভগবান গণেশ পুরাকালে দুপুর ১২টা ৪২মিনিটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই কেউ যদি সেই সময় ভক্তি ভরে গণেশের পূজা বাড়িতে করেন তা অত্যন্ত শুভ বলেই বিবেচিত হবে।
কীভাবে বাড়িতে ভগবান গণেশের পূজা করবেন
ভাদ্র গণেশ চতুর্থী অর্থাৎ ১৩ই সেপ্টেম্বর সকাল বেলায় পরিষ্কার করে ভালোভাবে স্নান করে শুদ্ধ কাপড় পরুন। তারপর বাড়ির মধ্যে পূজার সামগ্রীতে থাকা মেটে সিঁদুর একটি পাথরবাটি বা কাঁসার বাটিতে নিয়ে তাতে বাড়ির মধ্যে থাকা পূজার জন্য যে গাওয়া ঘি আছে তা মিশিয়ে একটি গাঢ় প্রলেপ তৈরি করুন। তারপর বাড়ির সদর দরজার দুই দিকে দুটি স্বস্তিক চিহ্ন অঙ্কন করে তাতে ঋদ্ধি এবং সিদ্ধি লিখুন এবং বামদিকে শুভ এবং ডানদিকে লাভ লিখুন। ঋদ্ধি এবং সিদ্ধি হলেন ভগবান গণেশের দুই স্ত্রী এবং শুভ ও লাভ হলেন ভগবান গণেশের দুই সন্তান। এরপর বাড়িতে নিয়ে আসা গণেশজির মূর্তি কোন কাঁসার থালায় নিয়ে রাখুন। এতক্ষন পর্যন্ত যেন মূর্তির মুখ ঢাকা থাকে। অর্থাৎ থালায় নেওয়ার আগে পর্যন্ত। এবার গণেশজির অভিষেক করুন।
তবে মাটির মূর্তির চেয়ে ধাতু বা পাথরের তৈরি মূর্তি অনেক বেশি কাজ দেয়। মনে রাখবেন অভিষেক করার সময় ভগবান গণেশের মুখ যেন দক্ষিণ দিকে এবং যে বা যারা অভিষেক করছেন তাদের মুখ যেন উত্তর দিকে থাকে। সবচেয়ে ভালো যদি করতে পারেন ষোড়শ অভিষেক করতে এবং দক্ষিণাবর্তি শঙ্খ অভিষেক। অভিষেক হওয়ার পর গঙ্গাজল দিয়ে ভগবান গণেশের সারা দেহ ভালো করে ধুয়ে শুদ্ধ কাপড় দিয়ে ভালোভাবে শরীরের মধ্যে থাকা জল মুছে ফেলুন। এরপর বাড়ির মধ্যে উত্তরপূর্ব দিকে মুখ করে গণেশজিকে পূজার ঘরে স্থাপন করুন।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি যে ঘরে গণেশজি স্থাপন করেছেন সেই ঘরের সঙ্গে আপনার শৌচাগার বা বাথরুমের কোন সরাসরি সংযোগ না থাকে। আর ভগবান গণেশের সামনের দিক যেন বাড়ির সদর দরজার দিকেমুখ করে থাকে। এতে বাড়ির মধ্যে থাকা নেগেটিভ এনার্জি বেরিয়ে যেতে থাকে এবং বাড়ির মধ্যে পজিটিভ এনার্জি আসতে থাকে।
সিঁড়ির নীচে এবং দক্ষিণ দিকে গণেশ মূর্তি যেন স্থাপন করা না হয় কোনদিন। গণেশজিকে ভালোভাবে মুছে নিয়ে তাকে নতুন বস্ত্র পরিধান করিয়ে দিন তার গলায় মালা পরিয়ে দিন। তাকে অলঙ্কার দিয়েও সাজিয়ে দিতে পারেন আপনার সাধ্যমতো। তবে অবশ্যই মনে রাখবেন ভগবান গণেশের গলায় পৈতে অবশ্যই পরাবেন। এবার পূজার সামগ্রীর মধ্যে থাকা একটা গোটা সুপারিকে নিয়ে তাকে মৌলী সুতো দিয়ে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিন। এরপর এর উপর ঘি এবং মেতে সিঁদুর মাখানো যে প্রলেপ ছিল তার একটি ছোট টিপ পরিয়ে দিন। এছাড়াও গণেশ মূর্তিতে লাল চন্দনের টিপ অবশ্যই দেবেন।
এবার অবশ্যই ২১ টির মতো দূর্বাঘাস একসাথে বেঁধে নিয়ে তাতে মেটে সিঁদুর ও ঘি এর প্রলেপ লাগিয়ে ভগবান গণেশের পায়ে কারজোরে নিবেদন করুন।এবার একটি পিতলের থালার উপর একটি পান পাতা এবং বিজোড় সংখ্যক তিল নাড়ু বা মোদক থাকলে অবশ্যই মোদক দিয়ে গণেশের পূজা মন্ত্র না জানা থাকলে ওঁ গাং গনপতয়ে নম: এই মন্ত্র ১০৮বার ভক্তি ভরে জপ করে করজোড়ে প্রণাম করুন।প্রণাম করার সময় অবশ্যই নিজের মনের আশা ,আকাঙ্খার কথা ভগবান গনেশকে জানাবেন।এরপর গণেশের দ্বাদশ নাম পাঠ করুন।অবশ্যই পূজার সময় ধুপ জ্বালাবেন তার সাথে থাকবে ঘিয়ের প্রদীপ।এছাড়াও গণেশের উপলক্ষ্যে প্রসাদ হিসাবে সবুজ ফল যেমন আঙুর অথবা পেয়ারা এবং লাড্ডু প্রসাদ অবশ্যই দেবেন।প্রসাদে অবশ্যই ধানের কিছু কনা, গোটা আতপ অবশ্যই থাকবে।পূজা শেষ হলে অবশ্যই লাড্ডু প্রসাদ বাড়ির মধ্যে থাকা ছোটদের প্রথমে অবশ্যই দিন, তারপর বড়দের দিন।
গণেশ পূজার সময় নানান টোটকা
গণেশের পূজার সময় যে মৌলী জড়ানো সুপারিটি গত বছর থেকে ছিল তা বাড়ির মধ্যে ভক্তি ভরে রাখলে সকল রকম বাধা কেটে যায়।এটা আপনার কাছে শরীরে জড়িয়েও রাখতে পারেন।তবে মনে রাখবেন নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলে নিরামিষভোজী হতে হবে ,তবেই গণেশজির কৃপা দৃষ্টি বর্ষিত হবে।
গত বছরের মূর্তির সঙ্গে থাকা বা এই বছর পূজার পর ২১টি দুর্বাঘাস গুচ্ছকে একটি মাদুলিতে ভরে গলায় ধারণ করলে শরীর সুস্থ এবং স্বাভাবিক থাকে।তবে এক্ষেত্রে আমিষ ভোজন ত্যাগ করতে হবে।
গণেশজির পৈতের সুতো পূজার পর তার দেহ থেকে খুলে নিয়ে তাতে গণেশজির নাম স্মরণ করে সাতটি পাক দিন ।তারপর তাকে বাড়ির মধ্যে উপযুক্ত জায়গায় রেখে দিন স্বচ্ছ পলিথিনের মধ্যে ভরে।এই পাক দেওয়া পৈতে আপনাকে জীবনের সকল সমস্যা থেকে দূরে রাখবে।
বাড়িতে বিবাহ যোগ্য মেয়ে থাকলে ভগবান গণেশের পূজার ভোগে মালপোয়া নিবেদন করতে পারেন।এতে বিবাহযোগ্যা মেয়ের সুপুত্রের সাথে বিবাহ যোগ সত্বর দেখা দেয়।
পূজার সময় ১১টি লবঙ্গ এবং ১১টি গোটা সুপারি পূজার থালাতে রাখুন।তবে তা ব্যবহার করবেন না।পূজার পর তা বাড়ির মধ্যে সুরক্ষিত জায়গায় রাখুন।গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করতে যাওয়ার সময় তা আপনার সাথে নিয়ে যেতে হবে।দেখবেন আপনার কার্যসিদ্ধি হবেই।
আরও পড়ুন : রাশি এবং রঙ অনুযায়ী এইসব গণেশ পূজা অবশ্যই করুন, সাফল্য অবশ্যম্ভাবী
পূজার থালায় গণেশজির ভোগে ২১টি মোতিচুরের লাড্ডু বা বেসনের লাড্ডু নিয়ে তার সাথে ১০৮টি দূর্বা ঘাস নিবেদন করবেন,দেখবেন আপনার বাড়িতে ঋণের বেড়াজাল কখনোই আসবে না।
গণেশ পূজার সময় এই কাজ গুলি একদম করবেন না।
সাধারণত গণেশ পূজা ১০দিন ধরে চলতে থাকে বা গণেশ মূর্তিকে বাড়িতে রাখা হয়।তবে আপনি চাইলে তিন দিন, পাঁচ দিনও রাখতে পারেন।তবে যে কয় দিন ভগবান গণেশ আপনার বাড়িতে পূজিত হবেন ভক্তি ভরে সেইসব দিন আপনাকে মেনে চলতে হবে বেশ কিছু নিয়ম। যেমন…
আমিষ ভোজন
পেঁয়াজ এবং রসুন থেকে অর্থাৎ ভালোভাবে বলতে গেলে এইসব দিনগুলিতে আপনাকে নিরামিষভোজী হতে হবে।বাড়িতে মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ এবং রসুন যেন কিছু না থাকে।এইসব বাড়িতে গণেশ চতুর্থী থেকে থাকলে আপনি কোনদিনই ভগবান গণেশের কৃপাদৃষ্টি পাবেন না।
তাস, জুয়ো,লটারি বা শেয়ার বাজার খেলা
বাড়িতে গণেশ মূর্তি স্থাপিত হলে এইসব খেলা একদম খেলা যাবে না।শাস্ত্র মতে এইসব খেলা ধন সম্পত্তি যেমন গড়তে পারে তেমন কাড়তেও পারে।তাই ফাটকা জাতীয় কোন কিছু খেলা যাবে না বাড়িতে গণেশ ঠাকুরের মূর্তি স্থাপন করার সময় থেকেই।
বাড়ি ফাঁকা রাখা
শাস্ত্রমতে বাড়িতে গণেশ মূর্তি ভক্তিভরে স্থাপন করলে তাকে একা ছাড়া যাবে না।অর্থাৎ তার আপ্যায়ন করার জন্য সদা একজন উপস্থিত থাকবে গৃহে।অর্থাৎ বাড়ি ছেড়ে সবাই মিলে কোথাও একসাথে যেতে পারবেন না।
আরও পড়ুন : কোন গণেশ মূর্তির পূজা করলে কী মনস্কামনা পূর্ন হয়, জানুন সবকিছু
মানুষ ঠকাবেন না
গণেশ মূর্তি বাড়িতে স্থাপন হওয়ার পর থেকেই আপনি কিন্তু ভুলেও কর্মক্ষেত্রে বা অন্য কোথাও মজা করেও কাউকে ঠকাবেন না।অর্থাৎ প্রতারণা মূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না।
বাড়ির শান্তি বজায় রাখুন
বাড়ির মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে হবে বাড়িতে গণেশ ঠাকুর স্থাপিত হলে।অর্থাৎ বাড়ির মধ্যে কলহ, ঝগড়া, মনোমালিন্য, কথা বলাবলি বন্ধ করা এইসব কাজ করবেন না।
মদ্যপান করবেন না
পূজার দিন আনন্দ করবেন অবশ্যই।কিন্তু তা যেন মদ্য পান করে নয়।মদ্য পান করা গণেশ চতুর্থীর সময় ঘোরতর অপরাধের কাজ ।তাই ভুলেও মদ পান করবেন না।
উপরে বর্ণিত সকল কথা যুক্তি দিয়ে বিচার করার মতো মানসিকতা সবার থাকবে তা আশা করি না।তাই বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ নিজের ব্যাপার।যদি কেউ ভেবে থাকেন আমাদের দ্বারা কোন রকম কুসংস্কারকে বা ধর্মকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তা একদমই ভুল।আমরা সকল বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি এবং ভবিষ্যতেও তুলে ধরবো।