রাবণ বধে রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা রাত্রিকালে মহাদেবীর বোধন করেছিলেন। বোধিতা হয়ে দেবী গেলেন রাবণের বাসভূমি লঙ্কায়। সেখানে তিনি রাম ও রাবণকে দিয়ে সাত দিন ধরে যুদ্ধ করালেন। নবমীর দিন জগন্ময়ী মহামায়া রামের দ্বারা রাবণ বধ করেন। যে আট দিন দেবী রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখে আনন্দ করলেন, সেই আট দিন দেবতারা তাঁর পূজা করেন। রাবণ নিহত হলে নবমীর দিন ব্রহ্মা সকল দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে দেবীর বিশেষ পূজা করলেন। তারপর দশমীর দিন শবরোৎসব উদযাপিত হয়। শেষে দেবীর বিসর্জন। রাবণবধ ও সীতাউদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র দুর্গতিনাশিনী দুর্গার অকালবোধন করে নবরাত্র ব্রত পালন করেছিলেন। তাই এখনও নবরাত্রে ভক্তরা উপোষ রাখেন।
আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নবরাত্রি। মা দুর্গা এই সময় অর্থাত আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথি থেকে নবমী অবধি রাম-রাবনের যুদ্ধ চলাকালীন মোট ন’দিন নয়টি রূপ ধারণ করেন। পিতামহ ব্রহ্মা দেবীর এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন। নয়টি নামের নয়টি বৈচিত্রময় রূপভেদ। এঁরা প্রত্যেকেই দেবীর নয়টি কায়াব্যূহ মূর্তি। নবদুর্গা নামেই এঁরা বিশেষ পরিচিত।
শ্রীশ্রীচন্ডীতেই প্রথম মহিষাসুরমর্দ্দিণী মাদুর্গার নয়টি রূপের বর্ণনা ও মহিমা প্রকাশিত হয়। দেবীকবচ অধ্যায়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্লোকে নবদুর্গা সম্পর্কে লেখা হয়েছে –
প্রথমং শৈলপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী।
তৃতীয়ং চন্দ্রঘন্টেতি কুষ্মান্ডেতি চতুর্থকম্।।
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা।
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমম্।।
নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ নবদুর্গা প্রকীর্তিতাঃ।
উক্তোন্যেতানি নামানি ব্রহ্মনৈবমহাত্মানা।।
প্রথম রাত – শৈলপুত্রী
নবদুর্গার প্রথম রূপ। শৈল মানে পাহাড়। হিমালয় পর্বতের কন্যা দুর্গা। তাই তিনি এখানে শৈলপুত্রী। যাঁর অপর নাম সতী ভবানী, পার্বতী বা হেমবতী। হিমালয়ের আরেক নাম হেমবাহন হওয়ায় তাঁর কন্যা হলেন হেমবতী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের শক্তির একত্রিত রূপ এই দেবী ষাঁড়ের পিঠে আরোহিতা। তাঁর এক হাতে ত্রিশূল, অন্যহাতে পদ্ম।
দ্বিতীয় রাত – ব্রহ্মচারিণী
নবদুর্গার দ্বিতীয় রূপ। যিনি ব্রহ্মাকে স্বয়ং জ্ঞান দান করেন, ভক্তকেও ইনি ব্রহ্মপ্রাপ্তি করান বা মুক্তি দেন। তাই তিনি শান্তির প্রতিভূ। দেবীর ডান হাতে রুদ্রাক্ষের জপমালা, বাঁ হাতে কমণ্ডলু। তিনি ভক্তদের সুখ, স্বস্তি, শান্তি দান করেন।
তৃতীয় রাত – চন্দ্রঘণ্টা
নবদুর্গার তৃতীয় রূপ। দেবীদুর্গার মহিষাসুর বধের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের প্রদত্ত ঘন্টা যার মধ্যে গজরাজ ঐরাবতের মহাশক্তি নিহিত ছিল, চন্দ্রের চেয়েও লাবণ্যবতী ইনি। তাই একফালি চাঁদ মস্তকে ধারণ করেছেন দেবী। এই চাঁদের আকারই ঘণ্টার মতো। উজ্জ্বল বর্ণের দেবীর বাহন সিংহ। দশভুজা দেবীর দশ হাতে অস্ত্র। ত্রিনয়নী তিনি। যা শক্তি এবং সাহসের প্রতীক। দেবী অসুরের সঙ্গে যুদ্ধরত। বাঙালিরা এই রূপের দেবীদুর্গার আরাধনা করেন।
চতুর্থ রাত – কুষ্মাণ্ড
উষ্মার অর্থ তাপ। দুর্বিষহ ত্রিতাপ হল কুষ্মা। দেবী এই ত্রিতাপ নিজের উদরে বা অন্ডে ধারণ করেন অর্থাৎ সমগ্র সংসার ভক্ষণ করেন ইনি। নবরাত্রির চতুর্থ রাতে কুষ্মাণ্ড রূপে পূজিতা হন দুর্গা। তাঁর কোথাও আট, কোথাও আবার দশ হাত। সিংহবাহিনী দেবী দশ হাতে ধারণ করে আছেন আয়ুধ এবং কমণ্ডলু।
পঞ্চম রাত – স্কন্দমাতা
দেব সেনাপতি কার্তিকেয় বা স্কন্দের মা। আমরা যেমন দেবীকে গণেশজননী হিসেবে বেশি পুজো করি, পশ্চিম ভারতে তেমনই দেবী মান্যতা পান কার্তিকেয়র মাতা হিসেবে। কার্তিকের আরেক নাম স্কন্দ। নবরাত্রির পঞ্চম রাতে দুর্গা পূজিত হন স্কন্দমাতা রূপে। ত্রিনয়নী দেবী চতুর্ভুজা। ডানদিকের উপরের হাতে ধরে আছেন শিশু কার্তিককে। প্রস্ফুটিত পদ্ম থাকে দক্ষিণ হস্তে। বাঁ দিকের একটি হাত বরাভয় দিচ্ছে । অন্য হাতে পদ্ম। কোনও বাহন নয় তিনি বসে থাকেন ফুটে থাকা পদ্মের উপর।
ষষ্ঠ রাত – কাত্যায়নী
এই নাম এবং রূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক কাহিনি। বৈদিক যুগে কাত্যায়ন নামে এক ঋষি ছিলেন। এক পুত্রের পিতা কাত্যায়নের ইচ্ছে হয় একটি কন্যসন্তান লাভের। দেবী দুর্গার তপস্যা করে তিনি অভীষ্ট পূর্ণ করেন। তাঁর স্তবে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং দেবী দুর্গা জন্ম নেন মহারিশি কাত্যায়নের কন্যা রূপে। তখন তাঁর নাম হয় কাত্যায়নী।
সপ্তম রাত – কালরাত্রি
ঋগ্বেদের রাত্রিসুক্তে পরমাত্মাই রাত্রিদেবী। মহাপ্রলয়কালে এই রাত্রিরূপিণী মাতার কোলেই লয় হয় বিশ্বের।অনন্ত মহাকাশে নৃত্যরত কালভৈরবের দেহ থেকেই আবির্ভূতা ইনি দেবী যোগনিদ্রা মহাকালিকা বা কালরাত্রি নামে খ্যাত। ভীষণদর্শনা দেবী চতুর্ভুজ। তিন হাতেই অস্ত্র, একহাতে বরাভয়। নবদুর্গার সপ্তম রূপে দেবী উপাসিত হন কালিকা রূপে।
আরও পড়ুন : বিজয় দশমী কেন পালন করা হয়? জানুন এক অজানা কাহিনী
অষ্টম রাত – মহাগৌরী
সন্তানবত্সলা, শিবসোহাগিনী, বিদ্যুদ্বর্ণা মা দুর্গার প্রসন্ন মূর্তি। সাদা পোশাক পরিহিতা, চার হাত বিশিষ্টা দেবীর বাহন ষাঁড়। দেবীর এক হাত শোভিত বরাভয় মুদ্রায়, বাকি তিন হাতে পদ্ম, ত্রিশূল এবং ডমরু। প্রচলিত বিশ্বাস, নবরাত্রির অষ্টম রাতে তাঁর পুজো করলে সব পাপ ধুয়ে যায়।
আরও পড়ুন : মা দুর্গার প্রতিমা বানাতে বেশ্যালয়ের মাটি লাগে কেন?
নবম রাত – সিদ্ধিদাত্রী
নবদুর্গার নবম তথা শেষ রূপ হল সিদ্ধিদাত্রী। অপরূপ লাবণ্যময়ী চতুর্ভুজা, ত্রিনয়নী, প্রাতঃসূর্যের মত রঞ্জিতা যোগমায়া মাহেশ্বরী ইনি সকল কাজে সিদ্ধি প্রদান করেন। ভগবত্ পুরাণ অনুযায়ী, স্বয়ং মহাদেব দেবীদুর্গাকে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পুজো করেছিলেন। তার ফলেই মহাদেব সকল সিদ্ধি প্রাপ্ত হন এবং লাভ করেন অর্ধনারীশ্বর রূপ।
মহালয়ার সঙ্গে কৃষ্ণপক্ষের অবসান। দেবীপক্ষের সূচনা। পরদিন অর্থাত শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত ন’টি রাত্রি অবধি মাদুর্গার নয়টি রূপের পুজো। শরতকালীন এই নবরাত্রি তাই শারদ নবরাত্রি। মূলত শক্তির আরাধনা। নবরাত্রির পরদিন বিজয়াদশমীর সঙ্গে শক্তিপূজার সমাপন।