কোন রক্তের গ্রুপের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কম, কোন গ্রুপের বেশি

বিশ্বব্যাপী মহামারীর পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীদের নিত্যদিনের গবেষণায় উঠে আসছে নিত্য নতুন তথ্য। কোরোনা ভাইরাসকে কাবু করার জন্য সম্ভবপর সবরকম দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকরা। এবার গবেষকরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন কোরোনা ভাইরাসের সাথে মানুষের জেনেটিক ফ্যাক্টরের কোনো যোগসূত্র আছে কিনা।

সারা বিশ্বের জিন টেস্টিং ও জেনেটিক সিকুয়েন্সিংয়ের অন্যতম বড় একটি সংস্থা ২৩ অ্যান্ডমি। এই সায়েন্স রিসার্চ ফার্মে বর্তমানে গবেষণার মূল বিষয় কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণের সাথে মানুষের জেনেটিক ফ্যাক্টরের যোগসূত্র বের করা। এই যোগসূত্র বার করার জন্য লক্ষাধিক সংক্রমিত ব্যাক্তিদের ডিএনএ ডেটাবেস তৈরি করা হয়। এই গবেষণা থেকে উঠে আসা তথ্য রীতিমতন আশ্চর্যজনক! মানুষের জিন এমনকি রক্তের গ্রুপের সাথেও যোগসূত্র আছে করোনা ভাইরাসের। গবেষণায় আরও দেখা গেছে এবিও জিনের ওপর কোরোনা ভাইরাস সংক্রমন নির্ভর করে।

এবিও জিন কি?

এটি মূলত একটি প্রোটিন কোডিং জিন।এই এবিও জিন (আলফা ১-৩-এন অসিটাইলগ্যালাকটোসামিনাইলট্রান্সফারেজ এবং অলফা ১-৩ গ্যালাকটোসিল ট্রান্সফারেজ)। এটি রক্তের একটি বিশেষ রকমের শ্রেণী বিন্যাস যা নির্ভর করে রক্তের এই শ্রেণিবিন্যাস নির্ভর করে লোহিত রক্ত কণিকা এর ওপর। লোহিত রক্তকণিকার সারফেসে অ্যান্টিজেন উপস্থিত থাকে।

এই অ্যান্টিজেন দুই রকমের হয়, এ এবং বি। এই এ বা বি অ্যান্টিজেন ঠিক করে রক্তের গ্রুপ কি হবে। এর ওপর নির্ভর করেই রক্তের গ্রপের টাইপ এ, টাইপ বি, টাইপ এবি বা টাইপ ও হয়। এই নতুন গবেষণা জানাচ্ছে রক্তের এই টাইপ বা গ্রুপের ওপরই নির্ভর করে কোরোনা কোনও ব্যাক্তির শরীরে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে সেটা জানা সম্ভব।

কোরোনা সংক্রমণের নতুন আতঙ্ক

করোনার সংক্রমণে নতুন আতঙ্কের কথা উল্লেখ করেছেন আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব সার্জেনস ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা। তারা জানাচ্ছেন কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণের রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটছে। ব্রিটিশ জার্নাল অব হেমাটোলজি’তে এই গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের অনেকেরই ফুসফুসে ছোট ছোট মাইক্রো ক্লট হচ্ছে এবং ফুসফুসে সংক্রমন ছড়ানোর পরই ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করছে।

ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধায় ব্যাক্তি নিশ্বাস নিতে পারেনা এবং শরীরে অক্সিজেনের অভাবে ও চূড়ান্ত শ্বাসকষ্টে ব্যাক্তির মৃত্যু হয়। তবে শুধুমাত্র ফুসফুসের নয়, মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন অঙ্গেও রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। আয়ারল্যান্ড সহ নিউইয়র্কের বিজ্ঞানীরাও এই তথ্য পেশ করেছেন। মাউন্ট সিনাইয়ের নেফ্রোলজিস্টরা জানান কোরোনা ভাইরাস সংক্রমিত ব্যাক্তিদের মধ্যে অনেকের ডায়লেসিস করতে গিয়ে কিডনিতে রক্ত জমাট বাঁধতে দেখা যাচ্ছে। এটি ব্যাক্তি বিশেষে পৃথক। এরকম নয় যে সবার ক্ষেত্রে একই স্থানে রক্ত জমাট বাধবে। কারুর ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, কারুর হার্টে হওয়ার ফলে হার্ট ফেল তো কারুর কিডনি ফেল হচ্ছে কোরোনা ভাইরাস সংক্রমন থেকে।

কোন রক্তের গ্রুপের ঝুঁকি কতটা?

গবেষকরা সাড়ে সাত লাখ কোভিড রোগীর ওপর এই পরীক্ষা চালিয়েছেন। এই রোগীদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা কিছু তথ্য জানিয়েছেন।

প্রথমত, যাদের রক্তের গ্রুপ “ও”  সেই সব মানুষদের কোরোনা কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কিছুটা হলেও কম।

দ্বিতীয়ত, যাদের রক্তের গ্রুপ ‘এ’  তাদের শরীরে কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই বেশী। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এ ব্লাড গ্রুপের রক্তের মানুষদের শরীরে কোরোনা সংক্রমন ও তার প্রভাব অনেকটাই বেশী এবং এই ক্ষেত্রে ও ব্লাড গ্রুপের মানুষরা কিছুটা সুরক্ষিত।

২৩ অ্যান্ডমি জেনেটিক রিসার্চ ফার্মের গবেষকরা দেখিয়েছেন স্পেন এবং ইতালিতে কোরোনা ভাইরাস আক্রান্ত ১৬০০ জন রুগীর অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম (তীব্র শ্বাস কষ্ট) দেখা দিয়েছিল এবং তাদের প্রত্যেকের শরীরেই “এ” গ্রুপের রক্ত ছিল। অন্যদিকে তারা এও দাবি করেছেন যে এই গ্রুপের রোগীদের ৫০ শতাংশ ব্যাক্তিদের অবস্থার এমনই অবনতি হয় যে তাদের ভেন্টিলেটর সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। এই গবেষণার সাথে যুক্ত গবেষক অ্যাডাম অটন জানাচ্ছেন যে ও রক্তের গ্রুপের মানুষদের মধ্যে সংক্রমণের হার তুলনামূলক ভাবে কম দেখা গেছে।

আরও পড়ুন :- কোন ব্লাড গ্রুপে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি? প্রকাশ্যে সমীক্ষার ফল

ভাইরাসের একটি সাধারণ ধর্ম হলো যে তারা মানব শরীরে কোনো বাহক কোষ খুঁজে তার সাহায্যেই মানুষের শরীরে প্রভাব বিস্তার করে। কোরোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই বাহক কোষ হলো দেহকোষের ACE-2 (অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম) রিসেপটর প্রোটিন। এই কোষের সাথে কোরোনা ভাইরাস তার শরীরের স্পাইক-গ্লাইকোপ্রোটিনকে যুক্ত করে নেয় এবং তারপর ধীরে ধীরে মানব শরীরে প্রভাব বিস্তার করে।গবেষকদের মতে মানুষের শরীরে কোরোনা ভাইরাস কিভাবে সংক্রমিত হবে তা কিছু বিশেষ বিষয়ের ওপর নির্ভর করে যার মধ্যে প্রধান তিনটি বিষয় হলো রিসেপটর প্রোটিন, রোগীর বয়স এবং ইমিউনিটি বা শরীরের সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।